চিক বর্ষা সোঁদা টুপ পর্ব-৩
বদরুজ্জামান আলমগীর এর কবিতা-
১.
∆ ন হন্যতে হন্যমানে ∆
কৈ মাছ চাষাভুষা লোক- খানদানির কোন ব্যাপারই নেই তার মধ্যে: শক্তপোক্ত শরীর- পেটানো কাঠামো, গায়গতরে জেল্লার নামগন্ধ নেই, পুরো চামড়া খসখসে, সারা গায়ে কালশিটে দাগ, ঘষায়-বসায় রুক্ষসুক্ষ রুখ; অন্য পাড়ে মান্যবর ইলিশের ইস্ত্রিকরা মোলায়েম দেহবল্লরী, রীতিমত সুগন্ধিমাখা সাহেবসুবা লমলমা ইংরাজের বাচ্চা! অল্পেই তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন, সল্পেই গা ছেড়ে দেন।
কৈ মাছ কামলা কামিন নামহীন গোত্রহীন প্রান্তিক অন্ত্যজ মানুষ- ডৌল নকশার ধার ধারে না, বর্ষার প্রথম নিনাদে ইলিশ যখন পারিষদবেষ্টিত ব্যূহের অন্তরালে ভীত,পাগলপারা কৈ মাছ সঙ্গীর খোঁজে কানকো বেয়ে উজানের দিকে ছোটে: সঙ্গীর বদলে তার জন্য উজানে অপেক্ষা করে কোঁচের তীক্ষ্ণ ফলা, কোঁচের ফলাকে কৈ মাছ ভাবে শ্রাবণ দিনের প্রথম কদমফুল!
কৈ মাছ নিজেই নিজের পক্ষ ও প্রতিপক্ষে হাজির, নিজেকে আহত করে, আর শুশ্রূষায় ছটফটানি বাড়ায়, বাতাসের সঙ্গে আয়ুর হিস্যার দেনদরবারে নিদারুণ তৎপর, নিজেই নিজের কবর খনন করে, কানকোর রক্তে তিলক পরে নিজের মৃতদেহ সজ্জিত করে তোলে!
আগামী বর্ষায় সে আবার অন্তর্গত উল্লাসে প্রেম ও মৃত্যুর অঙ্গুরি পরিতে উজান পন্থে আসিবে- বাদল দিনের প্রথম কদমফুল ফুটিলে আসিবে, না ফুটিলেও আসিবে- ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে!
২.
∆ বিল হই ∆
তারা খসে নিঃশ্বাসে নাকফুলে নথে,
ভুলে বসে তনুমূলে চেনাশোনা পথে।
হাওয়াগুলি বাড়ি দেয় জানালার শিকে,
নদীও পাশ ফেরে খোলে কোনদিকে!
চখাচখী মঞ্জিলা ধ্যানে বসে ছোটার,
হাতে চুলে অনল আর নিরালা কুঠার।
কৃষিকাজে দুধঘরে পাতা পল্লব ভাসে,
লেবু বনে নিশিপাওয়া প্রতি প্রত্যুষে।
তুমি আমি বিল হই তেলিভিডা মোড়ে,
কে তোলে ফুল গো আগুনের পুরে!
বুক পাতি চৌচির সাতবাড়ি ঘাটে,
ডিঙা যদি ভিড়ে আশা নিলামের হাটে।
দেশে দেশে মনকড়া জামের কুঁড়ি,
ঘুম মাগি নির্ঘুম পাথর আর নুড়ি!
৩.
∆ কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি ∆
কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি
মেঘের পরে মেঘের শরণার্থী শিবির।
কারণ ছাড়াই শুনতে থাকি লাউনের বিল
জলি ধানের কোমর জড়িয়ে হাওয়ার ব্যাকুলতা
শুনতে থাকি।
অর্ঘ্য সেনের গলায় বসে জানলার বাইরে
দুয়ারের থেকে দূরে দিগন্তের সিথানে জলমগ্ন কথা।
নীলুফার ইয়াসমীনের কন্ঠে খয়েরি দেয়ালের বাইরে
ঝিরঝিরে নামে মেধাবী বর্ষার জল;
দেবব্রত বিশ্বাসের আহবানে আছড়ে পড়ে
রুয়াদরের বিল।
শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরের নকশি কাঁথায়
ফুটে ওঠে অন্তঃসলিলা তারা-
নমিত ধুলিপড়া তুলসি পাতা।
তাদের গানের নিচে আমি একা শুয়ে থাকি
জলমগ্ন পাথর- শ্যাওলা জলে ধুয়ে যায়
অনাগত জন্মের করতল।
মেঘ ঘন হয়ে আসে নিমজ্জনের ঘোরে-
কোন জানালার শিকে মাথা হেলায়ে দাঁড়িয়ে আছো আমার সিজোফ্রেনিক বোন;
পাথরের সঙ্গে শুয়ে থাকো কেন ও আমার ভাই!
ডুমুর পাতার এতো অন্তরাল, এতোটা নিভৃতি কম্পনের সাথে মিলিয়ে যাও কোথায় জননী আমার!
স্মৃতিডোরের ওই পাশে ধরো ভাগ করে নিই
মেঘেদের জমে ওঠা।
ব্যথা জমিয়াছে- ছায়া ঘনাইছে,
কোথাও এমন ঘনাইছে বুঝি!
ছবি- অর্ণব জানা
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
দীপক বেরা’র কবিতা-
১.
∆ ভ্রমণ ∆
একটা অতৃপ্তি আমাকে ছুটিয়ে মারে
ছুটছি মানে এই নয় যে, রাস্তার শেষে গন্তব্য
ভুল পথে ছুটে ছুটে রাস্তা বেড়ে চলে শুধু
পায়ের তলায় ক্লান্ত ঘোড়ার খুরের আওয়াজ
পেছনের দূরত্ব কমিয়ে অবিরাম ছুটে চলা
সময় গড়িয়ে চলে, বয়স বাড়ে..
ছুঁয়ে দেখা হয় না জীবনের মহার্ঘ অর্জন কিছু
মানুষের মতো অবয়বগুলো ক্রমে ফিকে হয়ে আসে
বিবর্ণ শরীরে এখন পোকাদের গুঢ় জটিলতা
অসমাপ্ত পথের পাশে, শূন্য পৃথিবীর নিচে
শুয়ে থাকে নিথর, এক ভ্রমণপিপাসু কঙ্কাল!
২.
∆ অন্ধকারের কারিগরি ∆
আস্তিনের নিচে আধশোয়া গণিতের ভ্রূণ
জ্যামিতির স্থিরচিত্রে তখনো লেগে রক্তছিটে
তদন্ত উৎসবে নামবে মস্ত গোয়েন্দাগিরি দল
এবার একে একে কত গল্প গাঁথা হবে
গোধূলির ভণিতাচিহ্নের পাশে,
ঘাতকেরা সভ্যতার ফিরিস্তি শোনায়—
কতটা রক্তপাত হলে, মৃত্যুও শিল্প হতে পারে!
কৌশলের ক্রমাগত বিস্ফোরণে উড়ে যায় প্রাণকণা
ইচ্ছেফুলের ছোট ছোট গন্ধ উবে যায়..
গড়ে ওঠে অন্ধকারের কারিগরি, কৃৎকৌশল!
৩.
∆ মন ∆
মালী রোজ ফুল তোলে, মালা গাঁথে
অথচ জানে না সে, তার হাতের স্পর্শের
এত যে নিত্য ফুল, চলে যায় কোথায়?
কোন্ উৎসবে, কোন্ প্রয়োজনে
মিশে যায় কার উৎসর্গে, কোন্ নিবেদনে?
নিত্য কাজের ছলে দেখে নি চোখ তুলে
কখনো কোনোদিন ফুলের রূপ-সৌন্দর্য
বিহ্বল হয় নি, কোনো এক মুহূর্তের তরে!
অপরূপ লাবণ্যবিভায় দিনান্তে রেখে যায় ফুল
তার নৈঃশব্দ্যলিপি, মর্মমূলে গেঁথে রাখে শোক
মন ছাড়া স্বপ্ন নেই, স্মৃতি নেই..
লক্ষ্মীপ্যাঁচা সারারাত জেগে বসেছিল পাঁচিলে
গভীর নিদ্রাশেষে—
ভোরের আলোয় কোনো চিহ্ন নেই তার..!
ছবি- অর্ণব জানা
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
সোমনাথ সাহা’র কবিতা-
১.
∆ অন্ধনির্জনতা ∆
"There are more things in heaven and earth than are dreamt of in your philosophy."
Hamlet : Shakespeare
অন্ধনির্জনতা থেকে একটু এগিয়ে যাও দেখবে একটি লোক ঢেউয়ের মতন আকুল হয়ে বাঁচার আশায় দাঁড়িয়ে আছে।
এখন আর একটু এগিয়ে যাও,
দেখবে ওটা আসলে লোক নয়, গাছ।
এইবার তুমি দৃষ্টিগুলোকে তীরের ফলার মতন ছুঁড়ে দিতেই দেখবে ও আসলে গাছ নয়, নদী!
তুমি দেখতে না পারার ব্যর্থতা দিয়ে প্রশ্ন করবে,
তা আবার হয় নাকি! গাছ কখনও নদী হয় ?
তুমি যুক্তি দেখাবে, পৃথিবীর লুপ্ত ইতিহাস থেকে তর্ক তুলবে আঙুল নাচিয়ে, লজিকের বই খুলে পাতার পর পাতা উল্টাবে।
কিন্তু বিশ্বাস করো আমার অন্ধ-মহাকালে যে বিষণ্ণতা জমে আছে তা দিয়ে আমি বোঝাবো
কীভাবে একটি লোক একদিন গাছ হয়ে নদীর মতন ভেসে যায়।
গাছের ভিতরে কোনো মেঘ থাকেনা। জানো ?
থাকে শুধু সাদা-কালো বিশ্বাসের বৃষ্টিধারা।
জীবনের সকল মৌনতা সিঁড়িভাঙা জলে ভাসিয়ে দিতে হয় নদী হওয়ার আগে।
কারণ, ঈশ্বর বইতে প্রদীপের সরলতা লাগে।
তুমি ভাবছো। ভাবছো, কীভাবে এতসব জানলাম ?
কারণ, আমিই তোমার বুকের পাশে বসে থাকা প্রথম পুরুষ।
২.
∆ মৃত্যুহীন প্রাণ ∆
"কবিকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় রাইফেলের নিচে
তারপর তার কফিন বাক্সের ওপর খোদাই করে দেওয়া হয়- এটা দেশদ্রোহীর লাশ
একে স্পর্শ করোনা"
-প্রবীর আচার্য্য
যে ঘরে আগুন লাগে তাতে বিষয় পোড়ে;
মানুষও পোড়ে কখনো কখনো।
আবার কখনো ছেলের চিতায় বাবাও পোড়ে নীরবে।
প্রশাসন আসে সহানুভূতির ঘন্টা বাজিয়ে।
তখন এমন এক ঝড় ওঠে যার ভিতরে বাতাস থাকেনা।
আঁধারের পেটে জ্বলতে থাকা ক্ষুধার আগুন ইতিহাসকে ডেকে আনে।
আর ইতিহাস আসে কার্তুজ পাল্টাতে।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আগুন লাগলে?
পোড়ে দেশ,
পোড়ে সভ্যতা,
পোড়ে সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি।
কেউ আসেনা প্রতিবাদের ঘন্টা বাজিয়ে।
পুড়তে পুড়তে বদলে যায় মানুষ।
পুড়তে পুড়তে বদলে যায় কুতুবমিনার-তাজমহল-ধর্ম-শিক্ষা-আইন-আদালত।
সব পোড়ারই গন্ধ ভাসে বাতাসে।
এই যেমন দুধ পুড়লে দুধের,
ভাত পুড়লে ভাতের,
প্রাণ পুড়লে প্রাণের।
তবে, ইতিহাস পুড়লে কোনো গন্ধ ভাসেনা বাতাসে।
এই ভাবেই হারিয়ে যায় বহু যুবকের ঘুম, এই ভাবে হারিয়ে যায় বহু যুবতীর লাশ।
অলংকরণ- মেহবুব গায়েন
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••