Sunday, 19 July 2020

কবিতা

শাপলা পর্ব -৭

কবি মণিশঙ্কর এর কবিতা-




১।।  ∆ মা-টি ∆



১.
বুড়ো মহুয়াগাছটির তলায় এলে
মায়ের কথা মনে পড়ে।
বাতের যন্ত্রণায় সারারাত কুঁকড়ে যায় ঘুম–
ব্রহ্মডাঙের মাঝে একা মহুয়াগাছটি সাক্ষী থাকে
পক্ষান্তরে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদকথার!

প্রতিরাতে মা মৃত্যুই কামনা করে–
কোন প্রতিষেধক ঠেকাবে তার রাত্রিজাগরণ!
পথে-মাঠে-ঘাটে মহুয়াগাছটিকেই দেখি–
আগামীদিনের কুঁকড়ে যাওয়া ঘুম দেখি;
তাদের বোঝা-বওয়া কোমরদুলুনিতে
রোধহীন ক্ষয়ে যাওয়া দেখি...

আজ আর মহুয়া গাছটি নেই।
ব্রহ্মডাঙটিও মুছে গেছে নিসর্গের চিত্রপট থেকে–
তারই বুকে আমি দখিনের হাওয়া নিই।
যে রস একদিন শুষে নিয়েছিলাম দু’ই নিটোল নিঙড়ে
সে আর চাঁদ আঁকে না আমার কপালে।

দখিনের বারান্দাজুড়ে ভেসে যায় মহুয়া গাছটির ঘুম–
চাঁদ ক্ষয়ে যায় পক্ষান্তরে...

২.
মাঝরাতের আঁধার জড়িয়ে মা একা ধান সেদ্ধ করে।
তার গন্ধের কুহক নিশ্চয়তা ছড়ায় গেরস্থালির ঘুমজড়ানো চোখে–
মায়ের কাঁকাল দিনে দিনে ন্যুব্জ হয় লেদা পলাশের মতো!

বছর ঘুরে আসে–
সন্ধ্যাতারা শুকতারা হয় নিয়ম মাফিক;
তারই সূত্র ধরে আমি মা’কে খুঁজি।
খলামকুচির রূপ পায় খেজুর রসের ভাঁড়–
আমি দখি।
দেখতেই থাকি...
কার্তিক-সন্ধ্যার হিম মেখে ভেসে উঠছে স্বর্গবাতি–
তাকে ঘিরে পূর্বজরা গাইছে তুষতুষালির গান।

হঠাৎ অ্যালার্মে বাজে সময়ের ডাক।
তন্দ্রাটুকু ছুটে গেলে নিয়ন ঝরে দেওয়ালজুড়ে;
আমি ছুটি–
ছুটতে-ছুটতে ছুটতে-ছুটতে
হয়ে উঠি মহুয়ার গাছ।
কতটা পথ পার হলে আর পাথেয় লাগে না শিখে নিই তারই কাছে।
আকাশের দিকে তাকাই– ছায়াপথ দখি।
দেখি, সন্ধ্যাতারা শুকতারা হয়ে আছে...

৩.
যতটা সমর্পণ মানুষকে তরল করে–
যতটা একাকিত্ব সব চাওয়ার সমাপ্তি ঘটায়,
আজকাল মাঝরাতে ঠিক ততটা একা হই।
নিজেকে তারল্য শেখাই–
নিঃস্বতার হাত ধরে মেঘ হতে চাই,
জীমূতবাহনের ত্যাগে মহত্ত্ব সাধি!

একসময় সব নিয়ন আয়েশ পায়–
জেগে ওঠে গভীরতর অন্ধকার;
তার হাত ধরে একে একে নেমে আসে
মঙ্গল-চাওয়া পূর্বজরা।
আমাকে ঘিরে ইনিয়েবিনিয়ে ছড়াকাটে;
আমার দেহের রোমকূপে প্রাণ পায় জীতা ষষ্ঠীর দিন–
আমি জল হয়ে যাই।
জলের আঁচলে মা নিশ্চয়তা চায়–
পুকুর ঘাটের দইচিড়া দানে তুষ্ট করে জীমূতবাহনকে।
আমি আঁজলা ভরে আচমন করি...
আঙুলসন্ধি চুঁইয়ে টুপেটাপে ঝরে পড়ে মা–
একমাত্র সম্বল কাঁসার থালার বিনিময়ে ফুলপ্যান্ট কিনে আনে!

আমি প্যান্ট পরি,
তার উপর বাহারি জামা,
তার উপর কোট,
বাঁধি টাই...

মায়ের আঁচল ফসকে সরে যায় জল–
মুখ ফিরিয়ে নেয় জীমূতবাহন
ষষ্ঠীর নিশ্চয়তা...




২।। ∆ লীন ∆



বিষন্নতার গুমোট পেরিয়ে এসেছি
শাল-পিয়ালের কাছে।
যতটুকু দাগ
লেগে বুকের ভিতরে, তাকে ভুলে গেছি
দুঃস্বপ্ন ভেবে। ছেড়েছি
বিজয়ীর ভাগ।

ইতিহাস-লিপিহীন এ ব্রাত্য জীবন
এরাই তো শিখেছিল মাটির বতরে
বীজ প্রেমে খেলা করে-
মৃত্তিকা-যাপন
মানে সর্বংসহা বৃক্ষ।

এই যে পাখ-পাখালি–
এ নিরন্তর জীবন–
সবটুকুতে গাঁথা থাকে
সুবিশাল অন্তরিক্ষ।

আমার তাই এখানে জানুপাতা-সন্ধ্যা!
আমার তাই এখানে নিত্য আসা-যাওয়া
লীন হয়! ওঠে সূর্য। প্রাণে প্রাণ–বন্ধ্যা
মাটি বীজবতী–থামে দাঁতালের ধাওয়া...




৩।।  ∆ দেহাতী নদী কিংবা শিশিরের দান ∆



এই অসময় দাহ– এই নিঃশব্দ শিশির,
ঘোড়ামুখ ধানের ডোগায়
দুধজন্ম বুনে উবে যায়
নিঃশেষ বন্ধুর মতো!
তুমি তার দুধবতী ধান...

এ বিশ্বাস প্রথম চুমুর,
এ বিষাদ অঘ্রাণের শেষ–
সবারটুকু শুষে নিয়ে
তুমিই মহৎ– প্রজ্ঞাবান!

আলপথে অভিমান তবু
হাহাকারে গেয়ে যায় গান!
অবজ্ঞায় পড়ে থাকে
দেহাতী নদীর শ্রম–
সকাল পিরিয়ে দেখি,
'বুদ্ধু' হয়ে পড়ে আছে
ঘামে ভেজা শিশিরের দান...



অলংকরণ - শুভদীপ প্রধান

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

5 comments:

  1. এই কবি দাবি করেন তিনি কবি নন । এইরকম দাবিহীন কাব্যভাষা যার আছে তিনি আর যাইই হোন অকবি নন ।

    ReplyDelete
  2. লেখাগুলো মুগ্ধ করল আমাকে ৷

    ReplyDelete
  3. লেখাগুলো মুগ্ধ করল আমাকে ৷

    ReplyDelete
  4. লেখাগুলি বেশ ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  5. দাদা, তোষালার আলাদাভাবে উচ্চারণ পেলাম, ঘোড়ামু ধানশিসের দুধজন্ম বুনে... বিস্ময় কিছু উচ্চারণ।

    মিহি ভোরের আবেগ দিয়ে শুরু করলে ব্যাথা দিলে। জীবনে ফেরার কথাও বললে। সমৃদ্ধ দাদা❤❤❤

    ReplyDelete