কবি পরান মন্ডল এর কবিতা -
১। নীলের গন্ধ
সেই আমি নীলগঙ্গায় গঙ্গাপুত্র বংশদণ্ড হাতে নীলকর রাজা, এই নিশিভোরের সাম্রাজ্য আমার-- দ্রোহীরা নিরুদ্দেশ আছে ঘুমের ভিতরে; নীলাভ-নীল মণি'র ভূষণে সিংহাসন রাঙা |
এসেছি রক্ত-লাল-উতরল তোমার দেশে--আসার তো কথা ছিল না; দয়াবান আকাশ ছিল তোমার পাশে--উঁচু হয়ে সমুদ্র ধুয়েছে আমার পা |
নীল আকাশ নীল সমুদ্র ...আমার 'ই স্বদেশ--এই আমি নীলকর অখিল সরোবরে;মান্দাস ভাসাই আশ্বিনের সাদা পাল তুলে,বঁড়শিতে গেঁথেছি বড়ো এক নীল চিত্রফল, ভাগ নিয়ো পড়শি-পরজন---
বিজনে নিকট ছিলে ,এখন দূরে |
কোমড়ে বেঁধেছি দেখ বাঁশের খালুই-- জলজগুল্মে আছে ভ'রে ; রেশমের ডোরে সরু এক রামধনু ঝোলে,ফাতনায় ডানার গন্ধ-- অলখে-ঝলখে ময়ূর নৃত্য করে, সজনিগো দরজা খোলো-- রজনী আছো ঘরে?
আমি সেই পাগল মানুষ , ফানুস ওড়াই বাঁশের লগিতে-- লোকালয় বুঝে ছুড়ি ইন্দ্রজাল, উজলা-নোঙর ফেলি নদীর কিনারায় ; সজনিগো নীলের গন্ধ নিয়ো-- থেকোনা বিদ্রোহিনী লাল |
২। অনীশের বুকে জল-টলমল
১
অনীশের বুকে জল-টলমল তুমিই দিয়েছ -- ভৃঙ্গারে
নৃত্য জবার :
হাত থেকে খড়্গ , দেহ থেকে মুণ্ড নিয়ে মুণ্ডমালা
গলায় নিয়েছ -- নীলশস্যদানার
আবেগে যে-ভাণ্ডবিষ -- মন্থনের জলোচ্ছ্বাসে কুহেলিকাময় এই
সমুদ্দুর ;
তোমাকে শেখালো -- তুমি জাগরণে জরা, বোধিবৃক্ষে গৌতম বুদ্ধ আজও
প্রার্থনায় কপিলাবস্তুপুর |
২
অনীশের বুকে তখন জল-টলমল -- অনীশ জানল না ;
অসহ মেধার'পরে জেগে উঠল গোস্বামীর পাড়া--
শুঁড়িশাল থেকে উঠে এলেন
প্রভুপাদ গৌরাঙ্গ ঠাকুর --
নীল নীল সুনীলব্রহ্ম ধরে যদি এই সবিরুদ্ধ কাল --
ভুল সকাল ভুল রাত্রি এসে আকার-ইঙ্গিতে লিখে
দেয় প্রহসন মৃত্যুর ;
আস্তাবলে অশ্বারোহী ছিল ভালো ,ছিল ছেলে ভালো মায়ের কোলে -- ভাই আর বোন ;
জায়া-পতি বাপ-বেটা মিলবে কী ক'রে, খোঁজ নাও--
একজন রাক্ষস যদি অন্যটি নরগণ |
৩
অনীশের বুকে জল-টলমল ,চোখে বকুলবেলার আলো -- স্বর্গের পথ তার ছিল না কি জানা, সুন্দর
ছিল আমফুলে বনের মুকুল ; সজিনা ফুলে তখনোও তো কিছু সাদা আলো ;
শব্দের আড়াল ভেঙে নৈঃশব্দ্য সাজিয়ে রাখে কে?
প্রেরণা-মুখর এই সন্ধ্যা বেলা -- একাকী ঘরে ফেরার সময় যখন --
অনীশের দুঃখ নিয়ে বাল্মীকি-তাপস তুমি কিছু কথা বল!
৪
'বক্ষ ছিঁড়ে কী বেরোলো -- রামসিয়া না কি কফ শ্লেষ্মা?'
অভেদ আত্মা ভেদ ক'রে ওঠে পরিকল্পনা যত ,
দেহরূপ-উদ্যানে ঈশ ও অনীশ এখন অনন্ত
মালাকার ...
ধমনী থেকে নদী ,হৃদয় থেকে সমুদ্র ;প্রশ্বাস থেকে হাওয়া ,অশ্রু থেকে ঈশ'কে পেলাম ; আর --
এই কীটদষ্ঠ দেহকে ফেলে
জল-টলমল বুকে অমল আত্মায় অনীশ তোমাকে
পেলাম --
ঘুমের মতো বাঁশির মতো ...
আমার তো আর পুনর্জনম নেই !
৩। তখনও জাগেনি মেদিনী আসেনি গঙ্গা
*
তখনও জাগেনি মেদিনী আসেনি গঙ্গা :
শিথানে জল নিয়ে যখন প্রথম জন্মেছিলাম আমি অযোনিসম্ভূত-- অনেকগুলো জলরথ শূন্য ছিল
দেবতাদের জন্ম হয়নি তখনও শুধু মস্তবড়ো এক সাপের ভেলায় চ'ড়ে দুলেছিলে তুমি--
পুবে উঠেছিল প্রথম-সূর্য ভ্রমে ফুটেছিল লাল জবা:
কুসুম সঙ্কাশং-- সত্য অহং সত্য নাগদেহ সত্য আধেক শায়িত -- যুগসত্য ভূমা :
নয় সমুদ্র নয় রামধনুক-- সে এক সমুদ্রপালক পালকে রাঙা -- সে কথা জানে না ময়ূর সমুদ্র জানে না
এখন সৈকত জানে মামণি-মন্দারমণি জানে জানে মেছোমল্ল -- যে নৈরাশ্যের তুমুল আবেগে মধ্য সমুদ্দরে রেখেছে নোঙরের টান :
নৌকা-বুকে দুলে-ওঠা ঢেউ দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বুকে উঠে-আসা হিমজল
রাত্রিজল নোনাজলের সন্তাপ--
জন্মান্তর আছে শুধু অমরত্ব নেই জেনে
জনমে জনমে আমরা সমুদ্রে যাই --
অমৃত নয় , খুঁজে বেড়াই মন্থনের সাপ |
৪। নীলের সন্ধানে নিয়তিরাত সঙ্কাশ সঙ্কাশ
প্রথাগত পূর্বাভাস *
১
সঙ্কাশ সঙ্কাশ
....................
ধরা যাক হঠাৎ নিভে গেল
সূর্য ,তখনোও লেখা হয়নি শেষ সূক্ত
অগ্নিদেবকে জানিয়ে নমস্কার;
বিষণ্ন বসে আছেন ঋষি সংবহন
অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে পালকের কলম, আর
লেখার মস্যাধার |
ধরা যাক বিন্ধ্যাচল পাহাড়ে একা অগস্ত্যমুনি
আর্যদের নিয়ে যাবেন
দক্ষিণের দেশে ;
হঠাৎ এক লক্ষ উল্কাপিণ্ড তাঁকে জানাল প্রণাম
শূন্য থেকে এসে !
নেই জলঘড়ি
ছায়াঘড়ি
স্ফুলিঙ্গের ভিতর যখন দিগভ্রান্ত
তারাদের কম্পাস ;
তখনই বুকের ভিতর আত্মা
আত্মার ভিতর দম-দেওয়া ঘড়ি
জানান দিচ্ছে
সঙ্কাশ ...সঙ্কাশ ...
২
প্রথাগত পূর্বাভাস
..........................
ঋষি যায় ঋষি আসে লক্ষ ঋষি বন্দনায় বসে
নেভে সূর্য লক্ষ সূর্য ডোবে অন্ধঘরে
লক্ষ-দশ গ্রহপুঞ্জ ব্রহ্মাণ্ডে অনাথ হলে
মিথেনের আলো জ্বেলে শুয়ে কাটাব একটাই ঘুমের রাত
অতঃপর হাড়েকঙ্কালে হোক-না বর্ষব্যাপী যত উল্কাপাত
ধুলো-ধোঁয়া-অঙ্গার-অমৃতজল
পুড়ে যাওয়া মাটির ভৃঙ্গার
কোটি-লক্ষ মানুষের চোখে ঘন ঘন জেগে উঠছে
আদিম-অন্ধকার |
৩
নীলের সন্ধানে
.......................
কথা ছিল
নীলের সন্ধানে ঋষি'রা তারা হয়ে এক দিন
আকাশ-জন্ম নেবে
এখন নীল থেকে নিরুদ্দেশে যাওয়ার
সময় হ'ল আমারও
আকাশগঙ্গায় তারা'রা স্নান সেরে ঘুমিয়েছে, এই
হাস্যমান লোকব্রহ্মায় আমিও
অতিথি ব্রহ্মার
গলায় পরেছি তারাফুলের মালা
আমাকে প্রণতি জানায় ঋষি-অষ্টবসু
কোলে এসে বসে কালপুরুষ-বালক , জানে
মহাজাগতিক ঋষি'রা এই শূন্যলোকে
ফিরে আসবে আবার |
৪
ফিরে যাও নিয়তিরাত
..................................
যাও ফিরে নিয়তিরাত
ভূলোকে কুড়াও আত্মা
দু'হাতে কালো শস্যকণায় কর যজ্ঞের আয়োজন
কে কাকে কতক্ষণ
আঁচল বাড়িয়ে রাখতে পারে মায়ায়
দেহ ছেড়ে বিদেহি হয়
ভৈরব-ভৈরবী দু'জন |
যে তন্দ্রা থেকে জেগে উঠে ব'সে আছে বহুক্ষণ
দেহহীন উত্থান নিয়ে ব`সে ভাবছে আমরা স্বাধীন
যার দুঃখ নেই স্মৃতি জন্মের পূর্বাপর--
তাকে দিয়ো না দ্রাক্ষাকুঞ্জের মায়া, অকস্মাৎ ভ্রম
তৃষ্ণা পেলে নুনের শরবত দিয়ো এক গেলাস
চিনিবিহীন ;
বলে দিয়ো তারাদের ভাসিয়ে নদী স্বর্গ থেকে
অলকানন্দা
এ- মাটিতে নেমে আসবে না
কোনোদিন |
৫। বাড়ির নাম কখনো আকাশ হয় না '
উৎসর্গ: MalayPahari
বারান্দা --অর্ধেক প্রেম ; যখন উঠোনে
এলে -- অখিলের বুক,দেখ গান শোনে
পাঁজরে হু হু হাওয়া -- হাড়ে চিনচিন ;
অবিদিত মানব ও মানবী আনোখা ;
প্রেম -- যাপনে একটি আজীবন রেখা
থাকে, অনুভবে জেনো -- অচিনা-অচিন ৷
বারান্দা -- অর্ধেক প্রেম ; দেখে নাও গ্রিল
ধ'রে দাঁড়িয়ে আকাশ, পিপাসার্ত চিল --
ভালোবাসার ঘর ও বাড়ি যতক্ষণ ;
তুমি তো সংসারী নও , ভীরু-আনমনা ;
দু-টি মন ভিন্ন হ'লে বাড়ির ঠিকানা --
বল তো কে কবে লিখে রেখেছে কখন?
সুখীগৃহমন জানে সখ্য-ভালোবাসা --
ডেকেছ সন্ন্যেসি তাই , মেঘদূত এসে
দেয়াল গড়ায় যেন -- শিল্প প্রাকৃতিক ;
ভাবছ, একাকী তুমি বানপ্রস্থে যাবে --
যাবে যাও,কেটে পড়ো,আর পিছু ফিরে
দেখ -- আছে ভালো-মন্দ যত উন্নাসিক !
সুন্দর মুখটি যেন কত জানা শোনা ,
হায়নার দাঁত জানে রক্ত-স্বাদ নোনা --
লাল-জবা হলে চোখ হঠাৎ অচেনা ;
সংসার বিফল হলে ডাকে দশ দিক,
মলয় পাহাড়ি তবে বলেছিল ঠিক --
`বাড়ির নাম কখনো আকাশ হয় না ৷
অলঙ্করণ - অতীশ কুন্ডু
......................................................................
No comments:
Post a Comment