Friday, 17 July 2020

কবিতা

শাপলা পর্ব - ২

কবি পরান মন্ডল এর কবিতা -



১।   নীলের গন্ধ


সেই আমি নীলগঙ্গায় গঙ্গাপুত্র বংশদণ্ড হাতে নীলকর রাজা, এই নিশিভোরের সাম্রাজ্য আমার-- দ্রোহীরা নিরুদ্দেশ আছে ঘুমের ভিতরে; নীলাভ-নীল মণি'র ভূষণে সিংহাসন রাঙা |

এসেছি রক্ত-লাল-উতরল তোমার দেশে--আসার তো কথা ছিল না; দয়াবান আকাশ ছিল তোমার পাশে--উঁচু হয়ে সমুদ্র ধুয়েছে আমার পা |

নীল আকাশ নীল সমুদ্র ...আমার 'ই স্বদেশ--এই আমি নীলকর অখিল সরোবরে;মান্দাস ভাসাই আশ্বিনের সাদা পাল তুলে,বঁড়শিতে গেঁথেছি বড়ো এক নীল চিত্রফল, ভাগ নিয়ো পড়শি-পরজন---
বিজনে নিকট ছিলে ,এখন দূরে |

কোমড়ে বেঁধেছি দেখ বাঁশের খালুই-- জলজগুল্মে আছে ভ'রে  ; রেশমের ডোরে সরু এক রামধনু ঝোলে,ফাতনায় ডানার গন্ধ-- অলখে-ঝলখে ময়ূর নৃত্য করে, সজনিগো  দরজা খোলো-- রজনী আছো ঘরে?

আমি সেই পাগল মানুষ , ফানুস ওড়াই বাঁশের লগিতে-- লোকালয় বুঝে ছুড়ি ইন্দ্রজাল, উজলা-নোঙর ফেলি নদীর কিনারায় ; সজনিগো নীলের গন্ধ  নিয়ো-- থেকোনা বিদ্রোহিনী লাল |



২‌।     অনীশের বুকে জল-টলমল


অনীশের বুকে জল-টলমল তুমিই দিয়েছ -- ভৃঙ্গারে
নৃত্য জবার :

হাত থেকে খড়্গ , দেহ থেকে মুণ্ড নিয়ে মুণ্ডমালা
গলায় নিয়েছ  -- নীলশস্যদানার

 আবেগে যে-ভাণ্ডবিষ -- মন্থনের জলোচ্ছ্বাসে কুহেলিকাময় এই
সমুদ্দুর ; 

তোমাকে শেখালো -- তুমি জাগরণে জরা, বোধিবৃক্ষে গৌতম বুদ্ধ আজও 

 প্রার্থনায়  কপিলাবস্তুপুর |

অনীশের বুকে তখন জল-টলমল -- অনীশ জানল না ;

অসহ মেধার'পরে জেগে উঠল গোস্বামীর পাড়া--
শুঁড়িশাল থেকে উঠে এলেন 

প্রভুপাদ গৌরাঙ্গ ঠাকুর --

নীল নীল সুনীলব্রহ্ম ধরে যদি এই সবিরুদ্ধ কাল --

ভুল সকাল ভুল রাত্রি এসে আকার-ইঙ্গিতে লিখে
দেয় প্রহসন মৃত্যুর ;

আস্তাবলে অশ্বারোহী ছিল ভালো ,ছিল ছেলে ভালো মায়ের কোলে -- ভাই আর বোন ;

জায়া-পতি বাপ-বেটা মিলবে কী ক'রে, খোঁজ নাও--

একজন রাক্ষস যদি অন্যটি নরগণ |

অনীশের বুকে জল-টলমল ,চোখে বকুলবেলার আলো -- স্বর্গের পথ তার ছিল না কি জানা, সুন্দর
ছিল আমফুলে বনের মুকুল ; সজিনা ফুলে তখনোও তো কিছু সাদা আলো ;

শব্দের আড়াল ভেঙে নৈঃশব্দ্য সাজিয়ে রাখে কে?
প্রেরণা-মুখর এই সন্ধ্যা বেলা -- একাকী ঘরে ফেরার সময় যখন --

অনীশের দুঃখ নিয়ে বাল্মীকি-তাপস তুমি কিছু কথা বল!

'বক্ষ ছিঁড়ে কী বেরোলো -- রামসিয়া না কি কফ শ্লেষ্মা?'

অভেদ আত্মা ভেদ ক'রে ওঠে পরিকল্পনা যত ,
দেহরূপ-উদ্যানে  ঈশ ও অনীশ এখন অনন্ত
মালাকার ...

ধমনী থেকে নদী ,হৃদয় থেকে সমুদ্র ;প্রশ্বাস থেকে হাওয়া ,অশ্রু থেকে ঈশ'কে পেলাম ; আর --

এই কীটদষ্ঠ দেহকে ফেলে
জল-টলমল বুকে অমল আত্মায় অনীশ তোমাকে
পেলাম --
ঘুমের মতো বাঁশির মতো ...

আমার তো আর পুনর্জনম নেই !



৩।    তখনও জাগেনি মেদিনী আসেনি গঙ্গা

*

তখনও জাগেনি মেদিনী আসেনি গঙ্গা :

শিথানে জল নিয়ে যখন প্রথম জন্মেছিলাম আমি অযোনিসম্ভূত-- অনেকগুলো জলরথ শূন্য ছিল  

 দেবতাদের জন্ম হয়নি তখনও   শুধু    মস্তবড়ো এক সাপের ভেলায় চ'ড়ে দুলেছিলে তুমি--
পুবে উঠেছিল প্রথম-সূর্য ভ্রমে ফুটেছিল লাল জবা:

কুসুম সঙ্কাশং-- সত্য অহং   সত্য নাগদেহ   সত্য  আধেক শায়িত -- যুগসত্য ভূমা :

নয় সমুদ্র নয় রামধনুক-- সে এক সমুদ্রপালক পালকে রাঙা -- সে কথা জানে না ময়ূর  সমুদ্র জানে না 

এখন সৈকত জানে     মামণি-মন্দারমণি জানে জানে মেছোমল্ল --  যে  নৈরাশ্যের তুমুল আবেগে মধ্য সমুদ্দরে রেখেছে নোঙরের টান :

              নৌকা-বুকে দুলে-ওঠা ঢেউ   দীর্ঘশ্বাস
               নিয়ে বুকে উঠে-আসা হিমজল
               রাত্রিজল     নোনাজলের সন্তাপ--

               জন্মান্তর আছে শুধু অমরত্ব নেই জেনে
               জনমে জনমে আমরা সমুদ্রে যাই --

               অমৃত নয় , খুঁজে বেড়াই মন্থনের সাপ |




৪।       নীলের সন্ধানে নিয়তিরাত সঙ্কাশ সঙ্কাশ
                            প্রথাগত পূর্বাভাস                         *
সঙ্কাশ সঙ্কাশ
....................

ধরা যাক হঠাৎ নিভে গেল

 সূর্য ,তখনোও লেখা হয়নি শেষ সূক্ত

                           অগ্নিদেবকে জানিয়ে নমস্কার;

বিষণ্ন বসে আছেন ঋষি সংবহন

অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে পালকের কলম, আর

                                               লেখার মস্যাধার |

ধরা যাক বিন্ধ্যাচল পাহাড়ে একা অগস্ত‍্যমুনি

আর্যদের নিয়ে যাবেন

                                                দক্ষিণের দেশে ;

হঠাৎ এক লক্ষ উল্কাপিণ্ড      তাঁকে জানাল প্রণাম

                                              শূন্য থেকে এসে !

নেই জলঘড়ি

ছায়াঘড়ি

স্ফুলিঙ্গের ভিতর যখন দিগভ্রান্ত 

                                              তারাদের কম্পাস ;

তখনই বুকের ভিতর আত্মা

                            আত্মার ভিতর দম-দেওয়া ঘড়ি

                             জানান দিচ্ছে

                                             সঙ্কাশ ...সঙ্কাশ ...
প্রথাগত পূর্বাভাস
..........................

ঋষি যায় ঋষি আসে লক্ষ ঋষি বন্দনায় বসে

নেভে সূর্য লক্ষ সূর্য ডোবে অন্ধঘরে

লক্ষ-দশ গ্রহপুঞ্জ ব্রহ্মাণ্ডে অনাথ হলে

মিথেনের আলো জ্বেলে শুয়ে কাটাব একটাই ঘুমের রাত

অতঃপর হাড়েকঙ্কালে হোক-না বর্ষব্যাপী যত উল্কাপাত

ধুলো-ধোঁয়া-অঙ্গার-অমৃতজল 
                                পুড়ে যাওয়া মাটির ভৃঙ্গার

কোটি-লক্ষ মানুষের চোখে ঘন ঘন জেগে উঠছে
                                               আদিম-অন্ধকার |

নীলের সন্ধানে
.......................

কথা ছিল

নীলের সন্ধানে ঋষি'রা তারা হয়ে এক দিন

                                          আকাশ-জন্ম নেবে

এখন নীল থেকে নিরুদ্দেশে যাওয়ার

                                         সময় হ'ল আমারও

আকাশগঙ্গায় তারা'রা স্নান সেরে ঘুমিয়েছে, এই

হাস্যমান লোকব্রহ্মায় আমিও 

                                                অতিথি ব্রহ্মার

গলায় পরেছি তারাফুলের মালা

আমাকে প্রণতি জানায় ঋষি-অষ্টবসু

কোলে এসে বসে কালপুরুষ-বালক , জানে

মহাজাগতিক  ঋষি'রা এই শূন্যলোকে

                                        ফিরে আসবে আবার |

ফিরে যাও নিয়তিরাত
..................................

যাও ফিরে নিয়তিরাত

ভূলোকে কুড়াও আত্মা

দু'হাতে কালো শস্যকণায় কর যজ্ঞের আয়োজন

কে কাকে কতক্ষণ

আঁচল বাড়িয়ে রাখতে পারে মায়ায়

দেহ ছেড়ে বিদেহি হয়

                                          ভৈরব-ভৈরবী দু'জন |

যে তন্দ্রা থেকে জেগে উঠে ব'সে আছে বহুক্ষণ

দেহহীন উত্থান নিয়ে ব`সে ভাবছে আমরা স্বাধীন

যার দুঃখ নেই     স্মৃতি জন্মের পূর্বাপর--

তাকে দিয়ো না দ্রাক্ষাকুঞ্জের মায়া, অকস্মাৎ ভ্রম

তৃষ্ণা পেলে নুনের শরবত দিয়ো এক গেলাস

                                                        চিনিবিহীন ;

বলে দিয়ো তারাদের ভাসিয়ে নদী স্বর্গ থেকে 

অলকানন্দা

এ- মাটিতে নেমে আসবে না

                                                        কোনোদিন |




৫।     বাড়ির নাম কখনো আকাশ হয় না '
                                         উৎসর্গ: MalayPahari

বারান্দা --অর্ধেক প্রেম ; যখন উঠোনে
এলে -- অখিলের বুক,দেখ গান শোনে
পাঁজরে হু হু হাওয়া -- হাড়ে চিনচিন ;

অবিদিত মানব ও মানবী আনোখা ;
প্রেম -- যাপনে একটি আজীবন রেখা
থাকে, অনুভবে জেনো -- অচিনা-অচিন ৷

বারান্দা -- অর্ধেক প্রেম ; দেখে নাও গ্রিল
ধ'রে দাঁড়িয়ে আকাশ, পিপাসার্ত চিল --
ভালোবাসার ঘর ও বাড়ি যতক্ষণ ;

তুমি তো সংসারী নও , ভীরু-আনমনা ;
দু-টি মন ভিন্ন হ'লে বাড়ির ঠিকানা --
বল তো কে কবে লিখে রেখেছে কখন?

সুখীগৃহমন জানে সখ্য-ভালোবাসা --
ডেকেছ সন্ন্যেসি তাই , মেঘদূত এসে
দেয়াল গড়ায় যেন -- শিল্প প্রাকৃতিক ;

ভাবছ, একাকী তুমি বানপ্রস্থে যাবে -- 
যাবে যাও,কেটে পড়ো,আর পিছু ফিরে
দেখ -- আছে ভালো-মন্দ যত উন্নাসিক !

সুন্দর মুখটি যেন কত জানা শোনা ,
হায়নার দাঁত জানে রক্ত-স্বাদ নোনা --
লাল-জবা হলে চোখ হঠাৎ অচেনা ;

সংসার বিফল হলে ডাকে দশ দিক,
মলয় পাহাড়ি তবে বলেছিল ঠিক --
`বাড়ির নাম কখনো আকাশ হয় না ৷



অলঙ্করণ - অতীশ কুন্ডু
......................................................................

No comments:

Post a Comment