কবি অমর্ত্য দত্ত এর কবিতা-
১।। ∆ বিরহ ∆
(১)
পরিচয়হীন যে আলো, কোন চোখে নেবে তুমি তাকে ?
বসেছে নিশ্চুপে, ধীরে অথবা সে আজও বিরহিনী ।
রাতের ডানা থেকে খসে পরা দীর্ণ পালকের-
শরীরতো বিষাদ স্মারক, আঁধার মনের সঙ্গিনী ।
পরিচয়হীন যে ছোঁয়া, তাকে কোন বুকেতে জড়াবে ?
হৃদয়-উঠোন তার চারিদিকে স্মৃতি ভাঁঙা কাচ ।
সময় লহরী মাত্র, বিদ্রুপ পাশে রেখে যাবে ।
মোহ-ফুল ঝরে গেলে পড়ে থাকে শুধু কাঁটাগাছ ।
সুর যে বাঁচার মন্ত্র, সে কথা কী জানে বাঁশিওয়ালা ?
প্রহর গুনছে হাওয়া, ফিরে ফিরে চৌকাঠে থামে ।
হারিয়ে যাওয়ার পর রয়ে গেছে যেটুকু না বলা-
ও রাই তুমি কতখানি অধিকার চেয়েছিলে শ্যামে ?
আলো জানে, হাওয়া জানে, কে পুড়েছে বিরহের আঁচে ।
ছুঁয়ে দ্যাখো, দ্যাখো রাই সবেতেই শ্যাম লেগে আছে ।
(২)
এ'পলকে শ্যাম ঘন, সে'পলকে ভেসেছে কিনারা ।
নিথর দু'চোখ তবু পেয়েছে কী আলো ? মেঘে মেঘে
কেটে গেছে কতকাল । অবিরত বৃষ্টির ধারায়-
এক বুক জল নিয়ে কমলিনী কেনো আছো জেগে ?
অতীত স্মৃতির সুতো, বিরহ অবসাদ-পুঁতি ।
পারোনি ছিঁড়তে তুমি সেই মালা খুবদামি বলে,
বিঁধছে কাঁটার মতো তবু এ কেমন অনুরতি !
ও রাই যেওনা আর কালি মাখা যমুনার জলে ।
কুহকী যে সুর তার শিকড়েই প্রবঞ্চকতা ।
লুকিয়ে রেখেছো বুকে, জানো না সে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ।
কীভাবে ভুলবে তাকে ? কাকে তুমি শোনাবে সে কথা ?
বিথান শোকের বেশ, মলিনতা তোমাকে মানায় ?
এ'ভাবে খুঁজোনা আর এ'ভাবে বাড়িও না ক্ষতি ।
সে ছিলো, সে আছে আজও, চিরকাল থাকবে শ্রীমতির....
(৩)
কে বেঁধেছে চুল তার ? কে পোশাক দিয়েছে গুছিয়ে ?
সাঁঝের প্রদীপ কাঁদে আর কাঁদে কূল যমুনার ।
অভাগী দাঁড়িয়ে থাকে ডুবে যাওয়া জীবনকে নিয়ে ।
মন, বেঁধে নিতে চায় । চোখ বলে নেই সে তো আর....
প্রণয় এমনই হয় ? এমনই কী হয় গো প্রণয় ?
ফিরে এসো প্রসারিণী, সেই পথ কোরো না স্মরণ ।
হৃদয় দাহ্য বড়, স্মৃতিরা তো বহ্নিবলয় ।
শুধু পুড়ে ছাই হবে, ছাই হবে তুমি প্রতিক্ষণ ।
কে পেতে রেখেছে কোল ? কে কেড়ে নিয়েছে ঘুম তার ?
স্বপ্ন অলীক বস্তু, বিরহ জ্বাজল্যমান ।
যে বাঁশি বিষের, তাকে তুমি মেখেছো বারবার ।
অনঙ্গ সুর-রসে বিনোদিনী করেছিলে স্নান ।
ও রাই চোখ মোছো আর কেঁদো না কৃষ্ণাধিকারে....
তুুমি মিশে আছো তাই, তাছাড়া কে চেনে কানহা-রে ?
২।। ∆ জখম ∆
এ'ভাবে না ভাসালেও হোতো । ডুবে আছে হৃদয়-সরণী ।
বেঁচে থাকা আঘাতজনিত, সে কথা তো শরীর বোঝেনি ।
দু'চোখ মেখেছে ঘন মেঘ । পলকে বৃষ্টি বিষাদ ।
অধিকার খোঁজেনি জনমে । বোঝেনি ভেজা অজুহাত ।
এ'ভাবে ভাসালে বলো কেনো ? জানো এর গভীরতা ? মাপ ?
অগণন ছোবোল বিছানো । চারিদিকে ধ্বংসের ছাপ......
দ্যাখো চেয়ে অভিঘাতহীন যে পলক রাগ মল্লারে-
উঠেছিলো কোনো একদিন ভালোবেসে ভোরের সেতারে,
তাকে ছুঁয়ে এসে ছিলে নেমে, যে পথ ধরে রাধিকার মতো,
সেটা বিভেদের জখমে জখমে, এ'ভাবে না ভাসালেও হোতো ।
৩।। ∆ রূপকথা ∆
অনন্ত তখন নামেনি চোখের গভীরে ।
মাটিতে ছড়িয়ে ছিলো অজস্র হরশৃঙ্গার ।
তুমি নেমে গিয়েছিলে কুয়াশার হাত ধরে ।
আমি দূর থেকে দেখেছিলাম তোমার রজতশুভ্র জ্যোতি ।
পৃথিবী আলিঙ্গন করে তুমি তখন অর্ধশায়িত অনুরক্তা রুক্মিণীর মতো ।
অরণ্য শরীরে খেলে বেড়াচ্ছি বন্য হরিণের মতো একা ।
আমি একা ।
জ্যোৎস্নার ঘ্রাণ নিতে নিতে ।
অথবা এই জাগতিক অন্ধকারে আমার তোমাকেই শুধু চাঁদ মনে হয় ।
রাত্রি যখন একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরে নদীর মতো ।
আমি স্নান সেরে উঠে আসি ।
তখন আমার মাথায় রাজমুকুট,
কপালে বিজয়তিলক, শরীরে সুবর্ণ বর্ম পড়িয়ে দাও তুমি ।
আমার হাতে সপেঁ দাও পাঞ্চজন্য শরীর ।
তার মহাধ্বনীতে সূর্যোদয় হয় পৃথিবীর ।
সে এক অনন্ত রূপকথা চোখের গভীরে গেঁথে গেঁথে থাকে
অলংকরণ - শ্রীকৃষ্ণ কর্মকার
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
No comments:
Post a Comment