বদরুজ্জামান আলমগীর এর কবিতা-
১.
∆ বোবা কাহিনী ∆
কথা,কথার ভারে ছটফট করে নক্ষত্র তারাদের সাথে
বলতে বলতে, বলা হতে হতে তার কৌমার্য হারায়।
ফলে, এবেলায় বোবা হবার বাসনা আমার।
জানি না আমার দেখা হলো কার সাথে মধু আঙিনায়
বলে সে ভাষার মুক্তি নিরালা কথায়, নীরবতায়-
আমাদের পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষ উভয়ে থাকেন
জল ও হাওয়ার গভীরে, না বলা কথায়।
তোমরা বলো, বলতে বলতে মাইল কী মাইল চলে যেও।
আমি বসেছি কথা না বলার তাহাজ্জতি সাধনায়,
সব কথা বলবো আমি রবীন্দ্রনাথের সনে, বোবা মেয়ের
চোখের তারায়, ভিটগেনস্টাইনের বারামখানায়।
নীরবতা বলে যাবে আমার পক্ষে সকল কথা,
সব ঘুমের নহরে কিছু বলার বাকি রইবে না আর।
একটি প্রাণ আরেকটি প্রাণের তালুতে লিখে যাবে
আদিবাসী মন, চিত্রা হরিণের ভয়ার্ত চোখের লোবান
মঙ্গলগ্রহ অবধি সেলাই করা থাকবে হারিয়ে যাওয়া
ভাষাদের মর্সিয়া, ভৈরবী- আদিবাসী কৌমের জবান।
২.
∆ জন্মাষ্টমী ∆
রাধানাম রাধানাম কৃষ্ণ তুমি হও, বিলের পানি হয়ে নদী জুড়ে বও। দুধ, মধু, দই আর মিস্রির জল, আমপাতা, আনারস, বেদানার ফল। আহবান মুদ্রায় সুগন্ধি পানি, তুলসি পাতায় আমি অভিষেক মানি। চন্দনবাটা, কস্তুরী আর ধূলিস্নান, জালা ধান গুঁড়া ভাঙে কৃষ্ণের মান। লোহা নয়, কাঠ নয় মাটির বাসন, পেতে দিই তোমা লাগি ব্যথার আসন। মেঘে মেঘে আগুন আছে হিয়ার ডলক, সবা মাঝে কৃষ্ণ থাকে আইনাল হক।।
৩.
∆ রাবেয়া বসরীর পলাপলি খেলা ∆
সেইসময় রাবেয়া বসরীর নামে একটা গল্প চাউর ছিল : লোকে দেখে তাঁর এক হাতে আগুন আরেক হাতে পানি নিয়ে বেজান দৌড়ে যাচ্ছেন। এই আগুন আর জল দিয়ে রাবেয়া কী করবেন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন- পানি ঢেলে দোযখের আগুন নিভাবেন, আর আগুন দিয়ে বেহেস্ত জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবেন।
তাঁর জগদ্বিখ্যাত কবিতাটিও তিনি তখনই লেখেন : জান্নাত মিসমার করে দেয়া হোক, যেন মনে না হয় আমি বেহেশতের লোভে তোমার পায়রোবি করি; জাহান্নাম তুলে দাও যাতে তুমি না ভাবো- দোযখের ভয়ে আমি তোমার ভজনা ইন্তেজামে নামি!
ওইসময়ে সুদূর মদিনা থেকে সৈনিক বেশে আসা হাসান ইয়াসার বসরীও পরম ও রাবেয়ার বাঁকা দুই চোখের নেশায় বসরা নগরীতে আটকা পড়েন। একদিন তারা দুজনে পলাপলি খেলায় মাতে। প্রথম পালা আসে হাসানের- তিনি নানা জায়গা ঘুরেটুরে অতিদূর এক কোণায় লুকান। কিন্তু রাবেয়া বসরীর হাসান বসরীকে খুঁজে পেতে তেমন সময় লাগেনি- সাত আসমানের ভাঁজের আড়াল থেকে রাবেয়া তাঁকে একলহমায় বের করে আনেন।
এবার আসে রাবেয়া বসরীর পালা- চকিতে রাবেয়া লুকান। হাসান বসরী তক্কেতক্কে নানা জায়গায় তালাশ করেন, ডানে-বাঁয়ে, উত্তরে- দক্ষিণে,পুবে-পশ্চিমে, আকাশে- পাতালে, স্বর্গে-মর্ত্যে- হেথায় খোঁজে, হোথায় খোঁজে তামাম বিশ্বজুড়ে; কিন্তু কোথাও রাবেয়া বসরী নেই।
হাসান বসরী হার মেনে চোখ বন্ধ করলে রাবেয়া পলকে বেরিয়ে এসে বলে এতো দূরে দূরে কেন খোঁজো- আমি একদম কাছে, তোমার বুকের ভিতর গায়েব হয়ে ছিলাম- তোমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলাম- দেখতে আমায় পাওনি!
৪.
∆ নির্বিকার বিন্দুটি ∆
কৃষ্ণ মাত্র ১৬বছর বয়সে বাঁশি বাজানো ছেড়ে দেন। তিনি যখনই বোঝেন রাধার মন তমাল গাছের একটি পাতা বুঝি কেঁপে উঠেছে, তখনই বাঁশিটি রাধার হাতে তুলে দিয়ে একটি দূরত্বের রঙে লুকিয়ে যান। এভাবেই লীলাবান কৃষ্ণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণে রূপান্তর লাভ করেন।
আবদুল হাই বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে জলের ঢেউয়ে মিশে মৃগেল মাছের চোখের মণিতে সিদ্ধ হন; মৃত্যুকে পরিধান করে আবদুল হাই মেঘের ধামে বিদ্যুতের পদ্মহেমে লোকান্তরে মেশেন। রঙমালা বেগম প্রতিদিন গণক ডেকে দিশা গুণিয়ে দেখেন- কবে আহা, তার সাধু হাই বাড়ি ফিরবেন! চুলার আগুন একাএকা তরকারি পুড়ে ফেলে, কিন্তু তার আঁচ তাকে ঘুনাক্ষরে স্পর্শও করে না। এভাবে রঙমালা একটি স্থিরবিন্দু, নির্বিকার ঈশ্বর হয়ে ওঠেন।
সন্ধ্যা গড়িয়ে ঢালুতে নামতেই প্রতিদিন নিরুপমা পিসিমার জ্যোৎস্নার ডালি সাজাতে ইচ্ছা করে। দুধেদুধে অন্ধ দুনিয়া দেখতে নিরুপমা পিসিমা ঝামায় কাসার থালাটি ঘষেন- ফলে থালা ঝকমক করে ওঠে। কাহার তরে জানি মায়াপাত্রে জ্যোৎস্না তুলতে দরজার দিকে যান। পিসিমা ভুলে যান, কবেই ওই দরজা আদিঅন্ত কালের জন্য বন্ধ হয়ে গ্যাছে!
পিসিমা নির্বিকার। নিরুপমা পিসিমা এভাবেই ভগবান হয়ে ওঠেন।
৫.
∆ কৃত্য ∆
লেখা একটি রিচ্যুয়ালিস্টিক ব্রত- নয়া ফসল ওঠার আগে ও পরে কলাপাতায় বিলের ঋষী জলের উপর ভোগ ভাসিয়ে দেয়া।
চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ালে সঙ্গেসঙ্গে বিষক্রিয়া হয় না; অনিবার্য মৃত্যু জমা থাকে দেহের সিন্দুকে, হৃদপিণ্ডের স্পন্দনে।
ভরা পূর্ণিমা রাতে চন্দ্রালোকের সাথে বুঝি চন্দ্রবোড়ার বাসর- অমৃতবধির তুমুল জ্যোৎস্না জোয়ারের সাথে বিষক্রিয়া শুরু হয়- তার কল্যাণে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, যেমত চান্নিতিথি ভরে জন্ম লয় গৌতম বুদ্ধ, শত ভিক্ষু আর ডুমুরফলের দল; লেখাও এমন, একটি আর্তস্বর পেইন্টিং, এমনই রিচ্যুয়াল।
আশুরার সময় তাজিয়া বের করার চরিতে কবিতার ওঙ্কার- কবি হায় হাসান, হায় হোসেন বলে পিঠে শিকল মারেন- এটিই তার কবিতা।
কে আসে, কে-বা যায়, তাতে কিছু যায় আসে না- পিঠে রক্তাভা- খোলা আকাশের নিচে নির্ঘুম দাঁড়িয়ে থাকে এক অনাগত জন্মমৃত্যুর দাগ- মকবুল ফিদা হোসেনের তাজিয়ার ঘোড়া।
অলংকরণ- মেহবুব গায়েন
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
"আমাদের পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষ উভয়ে থাকেন
ReplyDeleteজল ও হাওয়ার গভীরে, না বলা কথায়।" - চমৎকার। অসাধারণ।
"একটি প্রাণ আরেকটি প্রাণের তালুতে লিখে যাবে
ReplyDeleteআদিবাসী মন, চিত্রা হরিণের ভয়ার্ত চোখের লোবান
মঙ্গলগ্রহ অবধি সেলাই করা থাকবে হারিয়ে যাওয়া
ভাষাদের মর্সিয়া, ভৈরবী- আদিবাসী কৌমের জবান।" - একগুচ্ছ বর্ণাঢ্য চিত্রকল্প। ভীষণ ভালো লাগল।
"সন্ধ্যা গড়িয়ে ঢালুতে নামতেই প্রতিদিন নিরুপমা পিসিমার জ্যোৎস্নার ডালি সাজাতে ইচ্ছা করে। দুধেদুধে অন্ধ দুনিয়া দেখতে নিরুপমা পিসিমা ঝামায় কাসার থালাটি ঘষেন- ফলে থালা ঝকমক করে ওঠে। কাহার তরে জানি মায়াপাত্রে জ্যোৎস্না তুলতে দরজার দিকে যান। পিসিমা ভুলে যান, কবেই ওই দরজা আদিঅন্ত কালের জন্য বন্ধ হয়ে গ্যাছে!" - চমৎকার আন্তরিক সব শব্দগুচ্ছ। আমি অভিভূত। ভীষণ ভালো লাগল।
ReplyDeleteএ সব আত্নজাত পংক্তি অবিনশ্বর।
ReplyDelete