অপর্ণা বসু’র কবিতা-
১.
∆ কখনো লাইন পেরোই নি ∆
কখনো লাইন পেরোস না
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিলাম
সেই থেকে আর কোনদিন লাইন পেরোই নি
আমার স্কুল ছিল রেললাইনের ওপারে
দল বেঁধে স্কুল যেতাম
ঝাঁক ঝাঁক বন্ধু
সবাই আমায় ফেলে চলে যেত
আমি ফিরেও দেখতাম না
টুক টুক করে সিঁড়ি ভাঙতাম
ব্রীজে চড়তাম
বাবা বলেছিল
যা মানা করলাম তা কখনও করিস না
আমি না থাকলেও কথা শুনিস
সেইথেকে কখনও লাইন পেরোই নি
এখন কর্মস্থলে যাই
রোজ ট্রেন ফেল করি
সিঁড়ি ভাঙতে হাঁটু আটকে আসে
খোঁড়াতে খোঁড়াতে ব্রীজে চড়ি
সহযাত্রীরা সব আমায় ফেলে চলে যায়
আমি ব্রীজে উঠতে হাঁফিয়ে যাই
হাঁফাতে হাঁফাতে দেখি
লাইন চলে গেছে অনেক দূরে
বাবাও চলে গেছে অনেকদিন
রেললাইন আমায় বাবাকে মনে পড়ায়
বাবা বলেছিল
যত কষ্টই হোক কখনও লাইন পেরোস না।
২.
∆ পাশের বাড়ি ∆
আমার পাশের বাড়িটা নিস্তব্ধ
রোজ একা একা ঝিমোয় সারাদিন
সেই বাড়িতে কারা যেন এসেছে আজ
থাকতে কিম্বা বেড়াতে
কল কল নাদে ভরে আছে চারিদিক
বেশ অন্যরকম লাগছে
যেন কোথাও এসেছি হাওয়াবদলে
একঘেয়েমি থেকে মুক্তি
মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হাস্যরোল
কখনো উদাত্ত গলায় কোরাস
"ঝরঝর ঝরণা ঝরে রে"
একঝাক ময়না টিয়ার কিচির মিচির
হয়তো কোন সেলিব্রেশান চলছে
অথবা ফ্যামিলি পিকনিক
সাথে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন
পাশের বাড়িতে আনন্দ এসেছে
অবসরগ্রস্ত আমি বসে বসে
আজ সেই আনন্দের ফোঁটা
তারিয়ে তারিয়ে পান করছি।
৩.
∆ দূরত্ব ∆
তুমি আর আমি আজকাল
কথায় কথায় আগুণ হয়ে উঠি
অথচ আমরা গান হতে পারিনা
গান হলে সেতার আবার
আগের মত করে বাজত
সুরে সুরে ভরে উঠত
দৈনন্দিন সব অপ্রাপ্তি
তোমার দুচোখে থাকতো সেই প্রশ্রয়
অকারণে হাসতে পারতাম
অবলীলায় ছুঁতে পারতাম
আবার আকাশের দিকে চেয়ে
আষাঢ়ের অপেক্ষা করতাম
ঠিক আগের মত।
ছবি- নিশিপদ্ম
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
অনিরুদ্ধ সুব্রত’র কবিতা-
১.
∆ বাড়িটা আপাতত পরিত্যক্ত ∆
সফল হয়েছে, মধ্য নিশির চামচিকিরা
উড়ছে এবং ঝুলছে দেয়ালে
পছন্দ মতো বিপরীত বর্গক্ষেত্রে, খেলে
স্তব্ধ সিলিং ফ্যানকে 'ফুঁ' বলে বলে।
জানলার বাইরে কতগুলো জোনাকি
তাদের প্রশ্ন অন্য, অবান্তর ধরণের
রাত বাতির অবকাশে, মুখ্য হতে পারত
সবুজাভ ঝিকমিক অসুখের সুখে।
দুটি আরশোলা আজ বিছানায় শুয়েছে
শুয়ে শুয়ে হাসছে---'বিছানা না গড়ের মাঠ'
কিন্তু বলছে, মেঝের নিচের ফুটোতে
দম বন্ধ হয়ে আসে তাদের, দুঃখে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, জল ঢুকছে গর্তে
এক বিবাগী সাপ ফটকের ফোঁকর দিয়ে ঢুকল
তবু সারারাত ঘুমোতে পারল না---
পাথরের মেঝেতে নাকি একটা গন্ধ, স্যাঁতসেতে।
২.
∆ গ্যালারি ∆
পৃথিবীতে ছবির কোনো ক্ষমতা নেই, তা কিন্তু না
ছবি যখন মুখোমুখি কথা বলতে আসে, দেখি
আশ্চর্য ! সে জ্যান্ত মানুষের চেয়ে কম কিছু নয়
যুক্তি খণ্ডায়, নতুন যুক্তির শব্দবন্ধ সৃষ্টি করে
হতচকিত করে, আমাকে শাসায়
হারিয়ে ভুত করে দেয়, বিশ্বাসের খেলায়
তখন আমাকে আবার পড়াশোনা করতে
বসতে হয়, মলাট ছেঁড়া বইয়ের কাছে
পাতা গুলো ওল্টাতে হয়, পর পর
আঙুল দিয়ে বুঝতে হয়
সংখ্যা ও সমীকরণ অথবা শূন্য দর্শন
মুখস্থ করতে হয়--- যা কিছুতেই মনে থাকে না
এমন কতগুলো অনুবাদ বা অনুচ্ছেদ
আসলে ছবি গুলো তো আকাশ থেকে পড়েনি
পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান পরিস্থিতির মুহূর্ত
তারও মধ্যে আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ ইত্যাদির সমর্থনে
যার কৌণিক অবস্থানের পিছনে
ইচ্ছে, রং, বোধ, ভাবনা, প্রয়োগ কাজ করেছিল
শিল্প তখনই সুন্দর হয়ে ওঠে, যখন তা সত্য---
আমি কি আর এমনি এমনি ছবিগুলো দেখি...
৩.
∆ ব্যস্ত ∆
স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সার সার কলকব্জায়
প্রয়োজনের নিস্ক্রমণ দেখতে দেখতে ফিরতে হয়,
বড় রাস্তার ম্যারাথনে হাততালি দিতে দিতে
বেঁকে গেছে সমস্ত গলি পথ
স্ট্রিট আলোরা হাঁটছে ততদূর, যতদূর মানুষকে
ঠিকানা বলে দেওয়া যায়
দু'পাশের ঘর বাড়ির মিছিলে শ্লোগানেরা বিভৎস
ব্যস্ত হয়ে তুলছে মুঠো ভরা রোদ
যে সব পুরনো স্বার্থ বলেছিল--- অফিস ছুটি থাক
তারাও হাত পা ছুঁড়ছে আজ
বড় দ্রুত ছুটছে এক দূর-সমুদ্র-বাতাস আর
স্থানীয় বৃষ্টি, একটা হেস্তনেস্ত টানে
সবচেয়ে অস্পষ্ট কিছু কিছু ক্লিশে শব্দের মানে
কিছুতে খেয়াল করছে না ঝড়
মাঠে মাঠে স্বপ্ন-ব্যাপারীর গানে একটা তোলপাড়
শুরু হয়েছে মনের ময়দানে
পোশাক পাল্টে পরবর্তী নাটকের জন্যে এখন
প্রস্তুতির গতিশীল সন্ধে তৎপর
শুধু পা-খোঁড়া স্মৃতি-ভার নূব্জ ছায়াটা তখনও
একা একা আঙুলে গুনছে একটা একটা বিন্দুর
মতো যত গুপ্তচর অন্ধকার।
ছবি- নিশিপদ্ম
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
বর্ণজিৎ বর্মন এর কবিতা-
১.
∆ যাপনের দিন গুলি ∆
রোজ একটি চিতা হানা মারে
সমস্ত অস্থিত্বের রক্ত মাংসে
মা কৃষ্ণপক্ষের রাত জুড়ে
কাঁচা হলুদ , সর্ষের তেল মালিশ করে
ক্ষত স্থান জুড়ে
কি করে বাঁচি?
কি করে বাঁধি স্ব্প্নের ঘর?
কান্না চৈত্রেই শুকিয়ে গেছে
অনুভূতির জানালায় উপোসী কাক
হাহাকার হতাশার প্রাচীর বেড়ে ওঠে
বাসনা পূর্ণিমা খোঁজে -
জ্যোৎস্না সিঙ্গিমারি নদী ঢেউয়ে ভেসে যায়
২.
∆ রাত ∆
তারা রাজনৈতিক লোক
অ ক বোঝে না -
আমাকে সিস্টেম শেখাতে আসে
Phd গবেষক মাথা নিচু
একচালা ফুটো ঘর
যদি ভাঙে পিতার ভিটে ?
ভয়ে আর ঘুমহীন চোখ
রাত পাহারা দেয়
৩.
∆ বোধ ∆
সাধু শব্দ ফ্যাঁকাশে আজ।
সগর্বে ঘোষণা করে
টাকা বিনে চাকরি নেই
কি হবে শিক্ষিত গরীব দেশ?
গ্রামের গন্ধ শরীর জুড়ে
বর্ণমালা -এ পাপ আমাকে দিলে ?
কি করি চৈতন্য কাঁপে
বোধ আক্রান্ত ভীষণ রোগে
ছবি- বিপ্লব ভূঞ্যা
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
No comments:
Post a Comment