Wednesday 5 May 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


মৃত্যুঞ্জয় রায় এর কবিতা-





১.
∆  জাহাজ সঙ্গ ∆



আমার স্তনদ্বয়ের মাঝে নেশাগ্রস্ত জাহাজ এসে ডুবল 
তাঁর আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লেগেছিল শ্যাওলা,
কেন জানি না আমার ইচ্ছেই হল না দূরে ঠেলে দিই আগন্তুককে |
সমুদ্রের নোনা জল আমার নাভিমূলে ছলাৎ করে উঠল,
সাদা সাদা ফ্যানা, চ্যাটচেটে 
আমার চারপাশে গভীর সমুদ্রের রঙীন মাছ
ভেসে যাচ্ছে মরা শামুকের খোলোস|  
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না
কারা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রাতভোর জাহাজের গায়ে ছেদা করেছিল? কারা?
মাঝ সমুদ্র থেকে টানতে টানতে জাহাজটাকে কারা আমার বুকের উপর আছড়ে ফেলল? কারা?
আমার বুকের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চোরা বালির স্তর
জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে গেলে সেটা তুলে আনা বড় কঠিন |
বড় কঠিন |




২.
∆  য ব নি কা   প ড়ে ছে ∆




আরও বেশি রোমাঞ্চকর
নক্ষত্র শরীর থেকে
গড়িয়ে পড়ছে বিশল্যকরণীর রস,
খিমচে ধরা জামার নিচে নিঃশব্দ সাইরেন
সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে সকলের মুক্তিপথ|
অসুখের সঙ্গে আপোষ করে আমরা নামছি রক্তডোবায়,
পার্শ্বচরিত্র গুলো পাশ ফিরে যায় বলেই
পূর্ণিমার চাঁদ কাস্তে হয়ে যায়|
হদিস পাইনি আজও
সমতলে দাঁড়িয়ে পাহাড় টাকে যারা  বিশ্বাসঘাতক বলেছিল!
প্রতিদিন গোপনে গোপনে আদর কিনছি টাকার বিনিময়ে 
তারপর বিচ্ছিরি স্বভাবে জলকোষের ভেতরে আশ্রয় খুঁজছি,
ভাঙা মাস্তুল 
জাহাজের পাটাতনের ছিদ্র দিয়ে উঠে এসেছিল জল,
সব নিষিদ্ধ পথ খোলা
সহজ কথা সহজভাবে বলতে শিখিনি বলে 
আবর্জনার স্তূপে সাজানো হয়েছে চিতা| 
আকাশে উড়ছে শফেদ শঙ্খিনী
স্বভাব স্বপ্ন সুধা,
প্রতি রাতে বাবুদের প্রেমের পর শুকিয়ে যায় রাংতায় মোড়ানো রজনীগন্ধা|

শরীরের ঘাম
শরীরের গন্ধ
শরীরের খেলা
শরীর মগ্ন
শরীরে ঢালছি ঘি
আগুন ঝলসে উঠবে আরও 

আছড়ে পড়া ঢেউ বন্ধু নয় সুখের,
ডিম্বাণুর চক্রব্যুহ ভেদ করে
কোনো রহস্য উন্মোচিত হয়নি
তার আগেই বিশ্বাসের মুখে যবনিকা পড়েছে|




৩.
∆ ধ্রুবতারা পুড়ছে ∆



ইতস্তত করতে করতে ধ্রুবতারাটি গোত্তা খেয়ে পড়ল পাহাড়ের উপর 
শূন্যের দিকে চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে পাহাড়,
কত যুগ পর আকাশ টাকে অসহায় দেখাচ্ছে
আত্ম অহঙ্কারের মুকুট যেন গড়িয়ে পড়েছে|
যদিও এই শূন্যস্থান স্থায়ী নয়
তবুও অস্বস্তিকর,
বুকের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠলো
আকাশের কাছ থেকে শেষ সম্বল টুকু কেড়ে নিয়ে বাতাস আছড়ে ফেলল ধ্রুবতারাটি |
এক মুহূর্ত শান্তি নেই 
কখনও মেঘে মেঘে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে 
কখনও লাট্টুর মতন পাক খেতে খেতে সর্বশক্তি সঞ্চিত হাওয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে সবটুকু,
ধ্রুবতারার মৃত্যু ঘোষণা আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা|
কোন বিচার সভায় বিচার হবে? 
যিনি মহান দার্শনিক তিনি দর্শন বদলে দক্ষ জিভ দিয়ে চেটে ফেলছে চামড়ার জুতো,
সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকেছে প্রবাসী মাতব্বর
বুদ্ধিজীবি মহল ভাগাড়ে বসে শুধু আলোচনা সভাই করছে,
অন্যদিকে কোকেন আর কয়লার জুয়াড়ি ঠিক করে দিচ্ছে কোন পথে এগোবে বিচার |
ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে উর্বর অস্তিত্ব
চোরাপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে চোখ আর কণ্ঠ
আগে যে মাঠে সোনার ফসল ফলত এখন সেখানে শশ্মানের কান্না শুনতে পাচ্ছি,
একটা ধ্রুবতারা পুড়ছে 
পুড়ছে নিষ্প্রয়োজন আমি|




৪.
∆ আমার প্রেমিকার নাম ∆




আমার ঘুমের মধ্যে যে আমার পিঠে ছুরি মেরেছিলো
সে আমার পরিচিত কেউ,
ন্যূনতম শব্দ ছিল না পায়ের
ভয়ঙ্কর সতর্কতায় আমার ঘরে ঢুকেছিল|
আমার ক্ষত বিক্ষত পিঠ
আমি ছটফট করছি
আমার মনে হচ্ছে
আমার গলার কাছে মাংসপিন্ড দলা পাকিয়ে আছে,
চিৎকার করার শক্তিটুকুও নেই|
দিনের আলোতে আমাকে পাকড়াও করার হিম্মত যার ছিল না
আমি নিশ্চিত সেই  ছিল আমার ছায়াসঙ্গী,
প্রতি মুহূর্তে আমার গতিবিধির উপর নজর ছিল 
ঘাপটি মেরেছিল সঠিক সময়ের অপেক্ষায়|
পড়শির ঘরের আগুন পরিচিত হয়েও যেমন বন্ধু নয় ফুলকি ছিটকে এসে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিতে পারে সেও ঠিক তেমন পরিচিত,
তাঁর মুখ স্পষ্ট মনে পড়ছে কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁর নাম বলব না|
তাঁর উদ্দেশ্য কেবল এক প্রেমিককে হত্যা করা 
কারণ বর্ষার ঋতু চলে যাওয়ার পর বৃষ্টির ঘ্রাণ মুছে দিতেই এই চক্রান্ত 
অপরিচিত কেউ নিশ্চয়ই জানবে না যে বৃষ্টি আমার প্রেমিকার নাম |




৫.
∆ দ র জা য়  এ ল  চাঁ দ ∆



কেঁপে উঠল মোমের আগুন 
দরজার কাছে চাঁদ এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম,
হাতে জোনাকির লণ্ঠন|
আমি যে তৃষ্ণার্ত সে কথা ওকে কে বলল?
চাঁদে কি জল আছে?
সে বিষয়ে কি বলছে বিজ্ঞান মহল?
জল যদি থেকেও থাকে
সেই জলে যে বিষ নেই তার কি কোনো প্রমাণ পত্র বা দলিল আছে?
শূন্য থেকে শূন্যে ভেসে গেলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমে যায়
কিন্তু চাঁদের নরম শরীরে মায়ার আকর্ষণ আছে,
আমি সেটা অনুভব করছি|
আমার কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে চাঁদ
আমি এক ফুট উঁচু থেকে স্পষ্ট দেখছি পৃথিবী বৃহস্পতির খুব কাছে চলে এসেছে কিন্তু দুই গ্রহের কক্ষপথে এক সমুদ্র দূরত্ব,
হঠাৎ উত্তাল সমুদ্র
শো শো হাওয়ার শব্দ
ঢেউয়ের মতন ঘাম গড়াচ্ছে চোরা পথে 
মহাকাশে মৃত্যুঞ্জয় তান্ডব,
চাঁদ মাটিতে এসে নামতেই
গোটা বিশ্ব অন্ধকার
সপ্তর্ষিমন্ডল যেন বর্শি
দূর থেকে ধেয়ে এসে গেঁথে যাবে বুকে,
শ্বাসযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়বে|
সর্বনাশ হওয়ার আগে 
আমি নত হব বিশ্বের চৌকাঠে
চাঁদ যতই বাহানা খুঁজুক আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার,
সেই স্পর্ধায় মোম গলে যাওয়ার আগে 
ওর হাত ধরে মহাকাশে ওকে ওর অবস্থানেই ফিরিয়ে দেব।



অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

1 comment: