Tuesday, 29 October 2024

মুক্ত গদ্য

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 

শাশ্বত বোস এর মুক্ত গদ্য 


অথচ লাল বালুঘড়ি, হ্রস্বস্বর ও যামিনী কালের অসুখ

মাছ ধরার ছোট্ট ডিঙিটা এখনো তেরছা করে রাখা| ঠিক যেরকম আলো, সূর্য্যের গা থেকে ছিটকে এসে পড়লে, বালিতে সোনা বলে ভ্রম হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়| বিকেলের শেষ কনে দেখা আলো, নিজের জন্মদাগ মুছে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, লাল কাঁকড়ার বিচে পাড়ি জমিয়েছিল, কত শত আলোকবর্ষ আগে| এখনো হয়তো তার, পৌঁছাবার সময় হয়নি| তবু ভৈরবী রোদে, চিকচিকে বালির বদলে, সাগরের ফেনিল স্রাব গায়ে মেখে, বিচটার সারা গা বেয়ে, তখন হেঁটে চলেছে, কয়েক শত কিংবা কয়েক অর্বুদ, লাল কাঁকড়া| মাথার থেকে বড়, সামনে দুখানা দাঁড়া| সরু মোটা শরীর খানা দুলিয়ে, হেলে বেঁকে এগিয়ে চলেছে, দিগন্তের বিপরীতে| ঠিক যেমনটা কলিমুদ্দিন, ছোট বয়সে হামা দিত, এই নির্জন পুরুষোত্তমপুরে| তার বাপ দাদার সময় থেকে, এই অববাহিকায় বাস কলিমুদ্দিনের| তার ঈদ-পরব-রোজা-সেহরী-ইফতারী, সব কিছু জুড়ে, ক্ষুধা ভরা মানচিত্র আঁকে, এই নির্বিকার কাঁকড়ার দল| বর্ষার সময়, আকাশের গায়ে জোলো মেঘ লাগলে, ডিঙ্গিটাকে আলকাতরার পোঁচ লাগায় সে| অভ্যেসবশে, এবার শুধু ভেসে পড়বার পালা| এরকম কৃষ্ণকায় কল্পনায়, মায়াবিলাসী বিকেলে, আকাশের দিকে চেয়ে, সে বলে ওঠে, “মাছ বেইচ্চা, একদিন আমি বড়লোক হইবো|”

কিনারায় তার মা দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায়| নোনা জলে, ডিঙিটা নিয়ে ভেসে পরে কলিমুদ্দিন| লবনাক্ত ফেনা, ঝুপ করে ছিটকে এসে, তার শরীর ভিজিয়ে দেয়| সমস্তটা নুন, সে শুকনো চামড়ার নিচে শুষে নেয়| এখনো নিকে হয়নি তার, বাতচিত শুরু হয়েছে সবে| ছোকরী শরীরের নোনা, আর সাগরের পানি, দুটোই এখন এক কলিমুদ্দিনের কাছে| এক নিষিদ্ধ জগৎ, কিংবা দূর আকাশের গায়ে, গজিয়ে ওঠা মাংসের হাতছানি| 

মা টাকে নিয়ে ইদানিং চিন্তা হয় খুব| বুড়ির বয়স বাড়ছে, চোখের আলো নিভু নিভু| মা চলে গেলে, এই নিস্তব্ধ চরাচরে, সত্যিই কলিমুদ্দিন একা| সেদিন হয়তো, ওই কাঁকড়াগুলোই ওর টুঁটি টিপতে আসবে| নোনা উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে, নিজেদের মস্ত মাথা আর দাঁড়া দুলিয়ে, খুবলে খাবে, কলিমুদ্দিনের ঘুন ধরা, শরীরের মাংস| ভাবতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে কলিমুদ্দিন| জড়িয়ে ধরে বুড়ি মাকে| বুড়ি হেসে ওর জংলা চুলে হাত দেয়| মা ছেলের বাৎসল্যে, ওদের পাতার ঝুপড়িটা কেঁপে ওঠে| ফাঁক দিয়ে, আকাশের তারা দেখে কলিম| জ্যোতিষ্কব্যাপী শূন্যতায়, আকাশ ভেঙে ঝিকিমিকি তারা, নেমে আসতে চায়, মা-ছেলের মাঝখানে| 

বীথিকার বুক কাঁপিয়ে, বালুচরে হাওয়া ওঠে| ছুটতে ছুটতে, গ্রহণযোগ্য সূর্য্যসীমা পেরিয়ে, বনজ্যোৎস্নাকে বুকে করে, সেই হাওয়া পাড়ি দেয়, শহরের কোন এক অভিজাত কলতলায়| কলকাতা শহরের দক্ষিণতম প্রান্তে, কোনো এক সভ্য প্রদেশে, তখন কর্পোরেট সর্বস্ব ছেলেটি, তার নিজের মা কে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়, দশ তলার ছাতে| অশীতিপর বৃদ্ধার,স্মৃতিভ্রংশের সুযোগ নিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চায়, ছাত থেকে| সারাজীবনের জন্য, সমস্ত দায়ভার থেকে আক্ষরিক অর্থেই মুক্তি পাবার বিপন্ন উপায় খোঁজে| পিছনে তখন সকাল-বিকেলের, নারীবাদী সমীকরণ, "উফফ আর পারিনা | এ বুড়ি আমার লাইফ টা হেল করে দিল| বুড়ি মাগী বিছানায় বসে হাগবে, আর সব ঠেলা আমার |" বয়সের অনেক ভুল আর নিয়মমাফিক নোটিফিকেশনের মাঝে, ছোট হয়ে যাওয়া শরীরটা, হঠাৎ বলে ওঠে, "বাবু পাখি হবি?" 

দূরে কোন গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে, শূন্যে ঝাঁপ মারে মাছরাঙা, নতুন উড়তে শেখা বাচ্চাটাকে বুকে করে| ওরা একদিন ঠিক উড়ে যাবে, ওই লাল কাঁকড়ার দ্বীপ দিয়ে|  

ছবি- মেহবুব গায়েন 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Saturday, 26 October 2024

মুক্ত গদ্য

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 

প্রীতিলতা চাকী নন্দী’র মুক্ত গদ্য 

প্রকৃতির কোলে যাপন চিত্র 
     

নিবিড় যাপন মানে এক অনন্য ভালোলাগা তথা ভালোবাসা।নগর জীবনে হাঁপিয়ে উঠলে কখনও  কখনও একাকীত্ব বড় তৃপ্তি দেয়,বেঁচে থাকার রসদ জোগায়।নিভৃতে নিরালায় অতিবাহিত সময় পুুুরোটাই অনুভূতিময়।তেমনই এক যাপনের নাম বক্সা জঙ্গল আর  তার  পাহাড়।
সমতল থেকে উঁচুতে উঠতে উঠতে পৌঁছে যাই পাহাড়ি জনপদে,দূর থেকে নিজের শহরটাকে অচেনা মনে হয়।একাত্ম হয়ে যাই পথের দুধারে গাছ-গাছালি,পাহাাড়ি মানুষ  জন ও পশুপাখিদের সান্নিধ্যে।তাদের অবাধ স্বাধীনতা ----যেখানে তুমুল কোলাহল নেই,শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির পাশে দুরন্ত জিনিসকে নেওয়া যায়।পাখিদের কলকাকলির পাশাপাাশি  আতিথয়তা একরাশ মুুুুগ্ধতা আনে।পথ চলতে চলতে পৌঁছে যাই 'বক্সা দূূর্গ।'ইতিহাস জড়়া়নো সেই স্থানের ভগ্নদশায় মন ভারাক্রান্ত। জরাজীর্ণ দেওয়াল গুলোতে কান পাতলে শোনা যায় বন্দীদের ফিসফিস কানাকানি।ঘোড়ার পায়ের শব্দ,বন্দুক আর প্রহরীদের করুুণ ইতিহাস বলে দিয়ে যায়। দেশের জন্য ভালোোবাসার টান কতটা উৎসর্গীকৃত শহীদ স্মৃতি  সৌধ  তার প্রমান বহন করে চলেছে।
আরো বেশ কয়েকটি ধাপ পার হয়ে পৌঁছে যাই দূরে আরো দূরে ,অন্য জগতে ----যার নাম 'লেপচাখা'।বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষগুলোর কি অপূর্ব অভ্যর্থনা।সত্যিই হারিয়ে যাবার মতন পরিবেশ।রাতের বেলার ছবিটা পুরোটাই ভিন্ন।নিঝুম রাতের শূন্যতায় মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদ তার সৌন্দর্যের পুরোটা উজার করে ঢেলে দিয়েছে।চারপাশের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে নদী,পাহাড়ের ঝর্ণা কল্ কল্ ধ্বনি----নিদারুণ দৃশ্যের ছাপ ফেলেছে।বাতাসে ভেসে আসা শীতল তৃপ্তি ,দূর থেকে দেখা যায় অসংখ্য আলো।রাত বাড়লে শূন্যতা বাড়ে।পাহাড়ের সারমেয়দের চিৎকার আর ঘরগুলো থেকে বাচ্চাদের কান্নার শব্দে এক মন কেমন করা পরিবেশ।
নাগরিক সভ্যতার বাইরের জগতে দূষণ মুক্ত প্রকৃতি দুহাত বাড়িয়ে বন্ধুত্বের আবদার রাখে।আর সেই আবদারেই বার বার ফিরে যেতে ইচ্ছে  করে।রাত কাটতেই ভোর হয়,একটা নতুন সূর্য -‐-আরেকটা নতুন দিনের আবির্ভাব। যত্রতত্র বিনা পরিচর্যায় ফুটে থাকা নাদুস নুদুস রঙিন ফুলগুলো স্বাগত জানায় অবলীলায়। মুগ্ধ হই তাদের সম্ভাষণে।কোথাও এতটুকু দু:খ এসে তাড়া করে বেড়ায় না।প্রকৃতির উন্মুক্ত দরবারে ক্লান্তি নেই,ক্ষেদ নেই,ভালোবাসায় ভরপুর।অপূর্ব  সৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় অনন্ত সুখ।তাদের কঠোর যাপনে বিস্মিত হই। তবুও এতটুকু ক্ষোভ ধরা পড়ে না।রাতের মায়াবিনী চাঁদের নৈসর্গিক রুপে স্নাত হয় বিশ্বজগৎ।দরাজ প্রকৃতির কোথাও একবিন্দু খামতি নেই।গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত -বসন্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকে প্রকৃতির কোলে।   

 

ছবি- মেহবুব গায়েন 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Friday, 18 October 2024

প্রবন্ধ

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 

ভাস্করব্রত পতি’র প্রবন্ধ 


মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি বিষয়ক পত্রপত্রিকা


মেদিনীপুরের মাটি সংস্কৃতির মাটি। ঐতিহ্যের মাটি। সংগ্রামের মাটি। তাই এখানে পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতির নানা ঘরানা ঠাঁই পায় লেখনীর আঁচড়ে। গত কয়েক বছর ধরে মেদিনীপুরের বুকে জন্মগ্রহণ করেছে অসংখ্য লোকসংস্কৃতি বিষয়ক ম্যাগাজিন। কিছু হয়তাে পথ চলতে পারেনি। থেমে গিয়েছে। কিছু এখনও চলছে। আবার কিছু নবউদ্যমে শুরু করেছে। তবে এ ধরনের পত্রপত্রিকার সংখ্যা হাতে গােনা। তবুও তাদের নীরব কাণ্ডকারখানা আদপে জেলার বিলীয়মান সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস অবদান বৈকি! 
মেদিনীপুর থেকে এরকম অসংখ্য পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয় যেখানে অন্যান্য বিষয়ের সাথে লােকসংস্কৃতিকেও প্রাধান্য দিয়ে ছাপানাে হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হবে সৃজন, শব্দের মিছিল, এবং সায়ক, দেশকাল সাহিত্য, সকলের কথা, আপনজন, নােনাচাতর, উপত্যকা, কথামেঘ, লােককৃতি, মরশুমী, পথ, বিনির্মাণ, মেঠোপথ, সুস্বন, জ্বলদর্চি, অমৃতলােক, সূর্যদেশ, পিনাক, দিঘলপত্র ইত্যাদি পত্রিকার নাম। এবার বরং তাকাই লোকসংস্কৃতি বিষয়ক পত্র পত্রিকা ও তার সম্পাদকদের নামের দিকে। 
হারিয়াড় সাকাম -- সম্পাদক : ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক।
মহিষাদল বার্তা -- সম্পাদক : অধ্যাপক হরিপদ মাইতি।
সহজিয়া -- সম্পাদক : মধুসূদন মুখোপাধ্যায়।
অমিত্রাক্ষর -- সম্পাদক : অচিন্ত্য মারিক। 
পুণ্যিপুকুর -- সম্পাদক : ভাস্করব্রত পতি। 
আত্মানুসন্ধান -- সম্পাদক : অতনুনন্দন মাইতি। 
সাহিত্য সম্মিলনী -- সম্পাদক : রাজর্ষি মহাপাত্র ও কৃতিসুন্দর পাল। 
সমীক্ষাপত্র লোকায়ত -- সম্পাদক : ড. শ্যামল বেরা। এষণা -- সম্পাদক : শাস্তিপদ নন্দ। 
তাম্রলিপ্ত শারদীয়া -- সম্পাদক : জয়দেব মালাকার। লোকভাষ -- সম্পাদক : তরুণ সিংহ মহাপাত্র। 
দর্শন -- সম্পাদক : আভা চক্রবর্তী। 
অন্যস্রোত -- সম্পাদক : ফিরোজ খান। লোককথা -- সম্পাদক : হরপ্রসাদ সাহু। 
তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনী -- সম্পাদক : অশোক কুমার পট্টনায়ক। 
লােকায়ত -- সম্পাদক : তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত, শ্যামল বেরা ও শংকর মহাপাত্র। 
দণ্ডভুক্তি -- সম্পাদক : সন্তু জানা। 
মেঘবল্লরী -- সম্পাদক : প্রাণনাথ শেঠ। 
ইতিহাস দর্পণ -- সম্পাদক : স্বপন দাস।

সমীক্ষাপত্র লোকায়ত : একসময় পত্রিকাটি জেলার অন্যতম লোকসংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ এটির প্রকাশনা বন্ধ। কোলাঘাটের ক্ষারুই ইউনিয়ন স্কুলের একসময়ের শিক্ষক তথা গবেষক ড. শ্যামল বেরার সম্পাদনায় ২০০৩ থেকে এর পথচলা শুরু হয়। কিন্তু ২০০৭ থেকে বন্ধ। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও লােকসংস্কৃতি বিষয় নিয়েই পত্রিকার অবয়ব। সরকারি রেজিস্ট্রেশন (WBBEN/03/11233) ছিল পত্রিকাটির। কিন্তু আর্থিক সমস্যা এবং ব্যক্তিগত সমস্যার দরুণ পত্রিকাটি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী লেখাকে প্রাধান্য দেওয়া হত। পুঁথিপত্র, প্রাচীন নথি, মেলা, লােকগান, লৌকিক দেবদেবী, লােকশিক্ষা, লােককাহিনি, লােককথা, লােকচিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব পেত। থাকত লোকসংস্কৃতি বিষয়ক নানা অনুষ্ঠানের খবরাখবর। এখানে লিখেছেন তারাপদ সাঁতরা, শঙ্কর মহাপাত্র, তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত, ভাস্করব্রত পতি, মধুসূদন মুখোপাধ্যায়, ড. শ্যামল বেরা, সনৎকুমার নস্কর, যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী, আর্য চৌধুরী, গৌরকুমার মৌলিক, গােপীকান্ত কোঙার, নিতাই জানা, বিধান বিশ্বাস, অনিমেষকান্তি পাল, ইন্দুভূষণ অধিকারী প্রমুখ বিশিষ্টজন।

অমিত্রাক্ষর : মেদিনীপুর শহর থেকে প্রকাশিত অচিন্ত্য মারিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত একটি ভিন্ন স্বাদের পত্রিকা এই 'অমিত্রাক্ষর'। লোকসংস্কৃতির একটু অন্য ধারার লেখায় সমৃদ্ধ পত্রিকাটি। 'পোষ্টকার্ড' সংখ্যা দিয়ে শুরু। এ পর্যন্ত মোট ১১ টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটিতেই দুর্ধর্ষ উপস্থাপনা। কেবলমাত্র মেদিনীপুরের লেখকদের লেখা নিয়েই 'অমিত্রাক্ষরে'র নিয়মিত আত্মপ্রকাশ। বছরে একবার শারদোৎসবের আগে। অচিন্ত্য মারিকের সম্পাদনায় অত্যন্ত উঁচুমানের এই পত্রিকাটি লোকসংস্কৃতির অন্তর্লোক ছুঁয়ে যায়। বর্তমানে তা সারা রাজ্যে প্রচারিত এবং প্রসারিত। স্বয়ং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পত্রিকাটির কাটাছেঁড়া করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকার। সম্পাদকের নিজস্ব ভাবনায় মেদিনীপুরের মাটির লেখকরাই পারে কলকাতাকে টেক্কা দিতে। তা তিনি করেও দেখিয়েছেন। 
'পোষ্টকার্ড' সংখ্যার পর ২০১১ তে 'চড়াই' সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করে। ২০১২ তে 'শ্মশান' সংখ্যা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী উপস্থাপন। এর পরের বছর 'ছদ্মবেশ' সংখ্যা ছিল অসম্ভব সুন্দর একটা উপহার। ২০১৪ তে মেদিনীপুরের কবি বিতশোক ভট্টাচার্যকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করে। এই বছরই মেদিনীপুর টাউন স্কুলের ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। ২০১৫ তে পত্রিকার বিষয় ছিল 'আড্ডা'। পরের বছর 'এক যে ছিল দেশ'। ২০১৭ তে 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' নিয়ে সংখ্যাটি তো হটকেকের মতো উবে গিয়েছে। সম্পাদকের কথায় আর মাত্র একটি কপিই রয়েছে! ২০১৮ তে অমিত্রাক্ষর প্রকাশ করে 'কাঠবিড়ালি' সংখ্যা। অসংখ্য অজানা তথ্য সমৃদ্ধ ছিলো তা। বিশ্বের কাঠবিড়ালি নিয়ে এরকম সংখ্যা আগে কেউই করেনি। ২০১৯ এ মহাত্মা গান্ধীর জন্মের ১৫০ বছর উপলক্ষে বিশেষ 'গান্ধিজী' সংখ্যা পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। চলতি ২০২০ সালে পত্রিকার বিষয় 'গীতা ও কোরাণ'। মুখ্য উপদেষ্টায় জাহিরুল হাসান। 'অমিত্রাক্ষর' অবশ্য ঘুম কেড়েছে কলকাতার প্রোথিতযশাদের।

এষণা : আঞ্চলিক ইতিহাস, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক মুখপত্র 'এষণা' প্রকাশিত হয় পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা শহর থেকে। শান্তিপদ নন্দ পত্রিকাটির সম্পাদনা করেন। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত অন্বেষা গােষ্ঠীর (রেজিঃ নং এস/৩৫৩২৫/৮০) নিজস্ব পত্রিকা। পত্রিকার সাথে যুক্ত আছেন অম্বিকেশ দাশ, অমরকুমার মাইতি, হরেন্দ্রনাথ মাইতি, বীরকুমার শী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন পত্রিকার এক অন্যতম কর্ণধার তথা লেখক এবং গবেষক শিশুতােষ ধাওয়া। ১৯৯৯ সালে 'এষণা' পত্রিকা প্রকাশ করেছিল 'মন্দির মসজিদ স্থাপত্য' প্রেমী গবেষক ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ান স্মরণ সংখ্যা। গবেষক বিষ্ণুপদ পণ্ডাকে নিয়েও সংখ্যা হয়েছে। এগরা মহকুমা এলাকার সাংস্কৃতিক ইতিহাস ধরার পাশাপাশি দুই মেদিনীপুরের আঞ্চলিক ইতিহাসের টুকরাে টুকরাে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে এখনও।

লোকভাষ : লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস বিষয়ক পত্রিকা। ১৪১৮-এর পৌষ মাসে 'লােকভাষ' পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হলেও দ্বিতীয় সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করেছে ১৪২১ সালে। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন শিক্ষক গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্র। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বােদ্ধাদের নজর কেড়েছে। পাঁচমিশেলী লেখার সম্ভারে 'লোকভাষ' পেয়েছে বহু বিশিষ্ট গবেষক লেখককে। দ্বিতীয় সংখ্যার বিষয় 'লৌকিক দেবদেবী'। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের নামজাদা লােকগবেষকগণই এখানে লিখেছেন নিয়মিত। উল্লেখযােগ্য লেখকরা হলেন অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, সূর্য নন্দী, চিন্ময় দাশ, ড. শ্যামল বেরা, দীপককুমার রায়, আদিত্য মুখােপাধ্যায়, বিধান বিশ্বাস, বিজয় পাণ্ডা, মেঘদূত ভুঁই, জ্যোতির্ময় রায়, ভাস্করব্রত পতি, ড. প্রবালকান্তি হাজরা, ড. অসীমকুমার মান্না প্রমুখ। অত্যন্ত উঁচুমানের এই পত্রিকাটির অবয়ব নজরকাড়া। দামও সাধ্যসীমিত। ঝকঝকে সম্পাদনা। তবে আপাতত পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রয়েছে।

পুণ্যিপুকুর : 'মেলা-উৎসব-ব্রত-পার্বণ-পূজা-পরব' বিষয়ক বাংলাভাষায় প্রকাশিত একমাত্র পত্রিকাটি হল 'পুণ্যিপুকুর (ISSN NO- 23497254)। ২০১১-এর জানুয়ারিতে কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলাতে এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। বছরে দুটি সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন ভাস্করব্রত পতি। পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন মধুসূদন মুখােপাধ্যায়। তিনিই পত্রিকার লােগােটি এঁকেছিলেন। যা এখনও ব্যবহৃত হয়। এ-পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম দুটি সংখ্যা পাঁচমিশেলী লেখায় সমাদৃত ছিল। কিন্তু প্রতিটি লেখাই উৎসব বিষয়ক। তৃতীয় সংখ্যাটির বিষয় ছিল 'চড়ক ও গাজন'। পুণ্যিপুকুর-এর চতুর্থ সংখ্যায় বিষয় 'রাবণ'। কিন্তু এই রাবণ নিয়ে অসংখ্য লেখা পাওয়ায় পঞ্চম সংখ্যাটিও সেই 'রাবণ'-কে নিয়ে প্রকাশ করতে হয়েছে। ষষ্ঠ সংখ্যায় বিষয় রাখা ছিল 'ঘুড়ি'। এরপর প্রকাশিত হয়েছে পুণ্যিপুকুর ব্রত নিয়ে একটি মূল্যবান সংখ্যা। যা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বিহারের সাসারামে শের শাহ সুরীর সমাধিতে। উদ্বোধন করেন ড. মৌসম মজুমদার। খুব শিগগিরই প্রকাশিত হতে চলেছে পুণ্যিপুকুর পত্রিকার রথ সংখ্যা। 
ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে পত্রিকাটি সমাদৃত হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়া থানার হাউর-এর সাহড়দা গ্রাম থেকে এটি কাশফুল সংখ্যা এবং কৃষ্ণচূড়া সংখ্যা নামে প্রকাশিত হয় দু'বার। এখানে বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন ড. নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, ভবানীপ্রসাদ মজুমদার, ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতি, ড. অসীমকুমার মান্না, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিধান বিশ্বাস, ড. শ্যামল বেরা, জ্যোতির্ময় রায়, ড. প্রণব রায়, ড. সুব্রত মুখােপাধ্যায়, তরুণ সিংহ মহাপাত্র, অহিভূষণ পাত্র, গুরুচরণ খাটুয়া, ভাস্করব্রত পতি, দিগেন বর্মণ, ড. প্রবালকান্তি হাজরা প্রমুখ নামি দামি লেখকগণ। চৈত্রের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখের সংক্রান্তি পর্যন্ত বাংলার মহিলারা বৃষ্টির কামনায় 'পুণ্যিপুকুর ব্রত' পালন করেন। সেই ব্রতের নামেই পত্রিকার নামকরণ। শুধু 'পুণ্যিপুকুর' বিষয় নিয়েই আলাদা একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী সংখ্যার বিষয় 'রথযাত্রা'। এক দিকে পত্রিকাটি বহন করে চলেছে লােকসংস্কৃতির নানা অঙ্গনকে। অন্যদিকে পরিবেশ বাঁচানাের সংকল্পকে সামনে রেখে গ্রামীণ মহিলাদের ব্রতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবেই।

হারিয়াড় সাকাম : ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক সম্পাদিত 'হারিয়াড় সাকাম' পত্রিকাটি বাংলা এবং সাঁওতালি ভাষার রচনার এক উল্লেখযােগ্য পত্রিকা। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকাটি। আঞ্চলিক ইতিহাস, আঞ্চলিক সাহিত্য, প্রত্নতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি বিষয়ক অসংখ্য লেখায় সমৃদ্ধ ছিল হারিয়াড় সাকাম বা সবুজপত্র। ১৯৬৩ সালে এটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে দ্বিভাষিক পত্রিকা হিসেবে। প্রথম বছরে দুটি সংকলন। পরে ত্রৈমাসিক এবং তারও পরে মাসিক পত্রিকা হিসেবে (DL. No. Tam-695 dt. 16.6.84 Postal Regd. No.-WB/TMK-27) প্রকাশিত হতে থাকে শুধু সাঁওতালি ভাষায়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে পথ চলার পর মূলতঃ আর্থিক কারণে পত্রিকাটি ২০০৩ সালে তার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। শেষের দিকে পত্রিকাটি অবশ্য অনিয়মিতভাবেই প্রকাশিত হত। 
মেছেদার 'মারাংবুরুং প্রেস'-এ এর জন্ম। সাঁওতালি ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই প্রেসটির অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেই হবে। এখান থেকে বহু সাঁওতালি বই, সংকলন, অভিধান-এর পাশাপাশি প্রকাশিত হয়েছে গীতাঞ্জলি বা সেরেঞ সপেঞ, গল্পগুচ্ছ বা গামগাছলে এবং ঈশোপনিষদ-এর অনুবাদ। সাঁওতালি ছাড়াও সাদরি, মুণ্ডা, পাঁচপরগনিয়া, কুড়ুখ, কোল (হাে), ইংরাজি, সংস্কৃত ভাষার বই প্রকাশিত হয়েছে। 'হারিয়াড় সাকাম' পত্রিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মারাংবুরু প্রেসের নাম। এখনও মেছেদাতে প্রেসটির সাইনবাের্ড রয়েছে। কিন্তু এখানে প্রকাশনা বন্ধ। 'হারিয়াড় সাকাম'-এর প্রথম সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৩৭০-এর ১লা বৈশাখ। তখন দাম ছিল দশ নয়া পয়সা। পত্রিকার সভাপতি ছিলেন ড. সুহৃদকুমার ভৌমিক। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন বার্ষা হাঁসদা, সুরেন্দ্রনাথ টুডু এবং জ্যোতিষ হাঁসদা। পরবর্তীতে এই কমিটি বদলে যায়। পত্রিকায় ৪০ বছর পূর্তিতে পূর্বে প্রকাশিত বাছাই করা রচনার একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। পত্রিকার সাথে যুক্ত অনিল মণ্ডল, বীরলিটা হেমব্রম, মণ্ডল হেমব্রম, ধর্মদাস কিসকু, সাধন মাণ্ডি, কৃষ্ণরায় টুডুদের নাম উল্লেখ করতেই হবে।

মেঘবল্লরী : ছড়াকার তথা প্রধানশিক্ষক প্রাণনাথ শেঠের সম্পাদনায় 'মেঘবল্লরী'র (ISSN 23955961) বিশেষ সংখ্যা গুলো তো লোকসংস্কৃতির এক একটি মাইলস্টোন বলা চলে। ২০১৩ তে 'তুলসীমঞ্চ' সংখ্যা খুব আলোড়ন ফেলে দেয়। বাংলা সাহিত্যে এ বিষয় নিয়ে আগে কখনও কাজ হয়নি। এরপর 'প্রমিলা' সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২০১৪ তে। ২০১৬ তে প্রকাশিত হয় 'হলদিয়া' সংখ্যা। ৪১৬ পাতার একটি আকর গ্রন্থ যেন! ২০১৭ তে আবারও ধামাকা! প্রকাশিত হয় 'গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলো সংখ্যা'। ২৪০ পাতার একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই সংখ্যার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা একাডেমি লিটল ম্যাগাজিন ২০১৮ পুরস্কার জোটে 'মেঘবল্লরী'র। পরের বছর ২০১৮ তে পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার বিষয় ছিল 'লিটল ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদ ও প্রচ্ছদ শিল্পী' বিষয়। ২০১৯ তে আবারও বিশেষ সংখ্যা 'বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস' প্রকাশিত হয় প্রাণনাথ শেঠের সম্পাদনায়। ২০২০ তে এই পত্রিকার প্রকাশিতব্য বিশেষ বিষয় 'গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকশিল্প'। এরাজ্যের স্বনামধন্য লোকসংস্কৃতি বিষয়ক লেখকদের একত্রিত করে এক প্রামান্য ইতিহাস তুলে ধরছেন অজস্র প্রতিবন্ধকতা সামলে।

আত্মানুসন্ধান : ১৯৯৭ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে 'আত্মানুসন্ধান' নামের পত্রিকাটি। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা এটি। ফি বছর একটি সংখ্যা করে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে পত্রিকার সম্পাদনা করেন অতনু নন্দন মাইতি। মুখ্য উপদেষ্টায় কেদার দাস। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের 'গোপীনাথপুর প্রগতি ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশান' আয়ােজিত লোকসংস্কৃতি উৎসবের অন্যতম অঙ্গ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই 'আত্মানুসন্ধান' পত্রিকাটি। এই অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত রথীন মজুমদার, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, নবকুমার পাল, আলােক ঘােষ, অনিল পট্টনায়ক, সুদীপ সিংহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। বিভিন্ন সংখ্যায় আত্মানুসন্ধানে লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছেন ড. শ্যামল বেরা, ভাস্করব্রত পতি, সােমা মুখােপাধ্যায়, অজিত করণ, দিব্যেন্দু দাস, অতনুনন্দন মাইতি, ইমানুল হক, মন্মথ গােরায় প্রমুখ প্রবন্ধকারগণ।

তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মিলনী : এখনও পর্যন্ত তিনটি সংখ্যা আত্মপ্রকাশ করেছে। শেষেরটি তুলনামূলকভাবে আয়তনে বড়। গত ১৪১৯-এর 'বর্ষা' সংখ্যা হিসেবে শেষ সংখ্যা প্রকাশিত। সম্পাদনা করেছেন অশােককুমার পট্টনায়ক। সংগঠনের ১৬ তম বছরে পা রাখা উপলক্ষ্যে শেষ সংখ্যার বিষয় বেছে নেওয়া হয়েছিল তমলুক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'দি প্রদীপ' পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং তথ্য। এজন্য ১৯৫১, ১৯৫২, ১৯৫৩, ১৯৫৭, ১৯৬১, ১৯৬২ এবং ১৯৬৩-তে প্রকাশিত 'দি প্রদীপ' পত্রিকার (বর্তমান সম্পাদক চিত্তরঞ্জন কুণ্ডু) খবরাখবর নিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর পরে প্রকাশিত হল 'তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মিলনী'র তৃতীয় সংখ্যা। ১৯৯৪-এর ১৭ই জুলাই গঠিত হয়েছিল 'তাম্রলিপ্ত সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ'। এরপর গত ২০০২-তে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এতে লিখেছেন উমা নাগ, রামচন্দ্র ধাড়া, রাজর্ষি মহাপাত্র, বনানী মালাকার, ড. কমলকুমার কুণ্ডু, নীতিন রায়, নিতাই জানা প্রমুখ।

লােকায়ত : ১৪০১ বঙ্গাব্দে পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট থেকে প্রথম প্রকাশ ঘটে 'লোকায়ত' পত্রিকার। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক এই পত্রিকাটি তাপসকান্তি রাজপন্ডিত, ড. শ্যামল বেরা এবং শংকর মহাপাত্রদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকে। প্রতি সংখ্যায় ক্ষেত্রসমীক্ষালন্ধ এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও নিবন্ধ নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। 'আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতির সত্যরূপ অন্বেষণ করা এবং তুলে ধরা' - এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করাই লক্ষ্য পত্রিকার। 'লোকায়ত' মনে করে ইতিহাসকে গল্পে পরিণত করলে, তার পরিণতি দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। এই বিপদের হাত থেকে দেশ ও দেশের ইতিহাসকে বাঁচানােই আমাদের দেশপ্রেমের পরিচায়ক হয়ে উঠুক। এখানে লিখেছেন তারাপদ সাঁতরা, ড. নির্মলেন্দু ভৌমিক, মােহিনীমােহন গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর মহাপাত্র, শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, তপনকুমার দাস, অজিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. শ্যামল বেরা, তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত প্রমুখ।

লােককথা : তাম্রলিপ্ত লোকসংস্কৃতি উন্নয়ন সমিতির মুখপত্র হিসেবে প্রতি বছর মহিষাদল থেকে প্রকাশিত হয় লোককথা পত্রিকা। অত্যন্ত উঁচুমানের এবং গুণমানের এই পত্রিকাটি গবেষকদের কাছে সংগ্রহযােগ্য ম্যাগাজিন। মহামূল্যবান এবং তথ্য পরিপূর্ণ এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন কবি, লেখক হরপ্রসাদ সাহু। তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি ফি বছর নতুন রূপে ধরা দেয় পাঠকদের কাছে। ২০০৬ থেকে এর প্রকাশনা শুরু। নিয়মিত এবং ধারাবাহিকভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল থেকে আত্মপ্রকাশ করে চলেছে। নিটোল সম্পাদনার ফসল এটি। এখানে বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন ড. অসীমকুমার মান্না, দিগেন বর্মণ, তারাপদ সাঁতরা, বীতশােক ভট্টাচার্য, রােহিনীনাথ মঙ্গল, চিন্ময় দাশ, ড. প্রবালকান্তি হাজরা, ভাস্করব্রত পতি, প্রভাতকুমার দাশ, ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতি, শিশিরকুমার বাগ, সৌরভকুমার ভূঞ্যা প্রমুখ। হরপ্রসাদ সাহু সংগৃহীত 'সত্যনারায়ণের পালা'-র দেখা মিলবে লোককথার অষ্টম সংখ্যায়।

মহিষাদল বার্তা : ২০১২-এর জুলাই মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় মহিষাদল বার্তা পত্রিকার। হলুদ কাগজে ছাপা পত্রিকাটি এক অনন্য পরিবেশন। মহিষাদলের সংস্কৃতি সভার মুখপত্র এই পত্রিকাটিতে স্থান পায় লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্বের যাবতীয় তথ্য সম্বলিত উপাদান। মহিষাদল ঘিরেই লেখাগুলি আবর্তিত হয়। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক হরিপদ মাইতি। কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন হরপ্রসাদ সাহু এবং সৌরভকুমার ভূঞ্যা। স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকাটি হয়ে উঠেছে মহিষাদলের আয়না। এখানে বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন শিশিরকুমার বাগ, হরপ্রসাদ সাহু, সৌরভকুমার ভূঞ্যা, হরিপদ মাইতি, ভাস্করব্রত পতি, মানসী মিশ্র হালদার, পারমিতা গিরি, ড. সুস্নাত জানা, বিধান দত্ত প্রমুখ লেখকগণ। মহিষাদলের নানা খবরাখবরও গুরুত্ব দিয়ে ছাপানাে হয় পত্রিকাটিতে। 

অন্যস্রোত : গত ২০০৮-এর জানুয়ারি থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার ফিরােজ খানের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে লােকবিষয়ক পত্রিকা 'অন্যস্রোত'। একসময় ধারাবাহিকভাবে প্রতিমাসে প্রকাশিত হত। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব বিষয়ক মাসিক এই ম্যাগাজিনটি সারা রাজ্যে সমাদৃত। বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে বহুবার। পত্রিকাটিতে (রেজিঃ নং- WBBEN/2010/30681) নিয়মিত লেখেন বিমলকুমার শীট, রােহিণীনাথ মঙ্গল, ভাস্করব্রত পতি, ফিরােজ খান, যুগজিৎ নন্দ, দীপককুমার পাল, শান্তিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, নন্দদুলাল রায়চৌধুরী, লক্ষ্মীকান্ত পাল, কামরুজ্জামান, মহম্মদ সালাউদ্দিন, শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পুলকেন্দু সিংহ প্রমুখ লেখকগণ। 

সহজিয়া : লােকায়ত শিকড় সন্ধানের পক্ষে 'সহজিয়া' প্রকাশিত হয় বার্ষিক সংকলন হিসেবে। ২০০৫ থেকে প্রতিবছর প্রকাশিত হয় অত্যন্ত উচ্চমানের লোকসংস্কৃতি বিষয়ক এই পত্রিকাটি। মধুসূদন মুখোপাধ্যায় সম্পাদনায় প্রথম কয়েক বছর পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট থেকে প্রকাশিত হত। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবৎ পত্রিকাটি প্রকাশিত হচ্ছে হুগলির ত্রিবেণী থেকে। বইটির লেখার মান, প্রচ্ছদ-ভাবনা, অঙ্গসজ্জা, অলংকরণ এবং পরিবেশন সবেতেই উন্নত এবং মার্জিত রুচির আভাস লক্ষ করা যায়। ফি বছর এই বাংলার লােকায়ত কিছু মানুষজনকে প্রদান করা হয় পত্রিকার নামেই 'সহজিয়া সম্মান'। যা এই পত্রিকার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

দণ্ডভুক্তি : পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে গবেষক, শিক্ষক, লেখক এবং প্রত্ন সংগ্রাহক সন্তু জানার সম্পাদনায় গত ২০১৮ এর আগষ্ট মাস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে 'দণ্ডভুক্তি'। সহ সম্পাদনায় রয়েছেন পবিত্র পাত্র। দাঁতন অঞ্চলের বিশিষ্ট মানুষজনই এই পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা। দাঁতন থানা কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- এ তথ্য কেউই জানতেন না। সেই অনালোকিত ইতিহাস পত্রিকায় তুলে ধরেছেন সন্তু জানা। এই দাঁতন এলাকায় ডাক হরকরা কত দিন ধরে ছিল সেই অনালোচিত ইতিহাসও উঠে এসেছে সন্তু জানার গবেষনায়। ১৮৭০ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'মিশনারি হেল্পার' (১৮৪০ সালে এই পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়) পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে ভারতের চারটি যায়গা দাঁতন, বালেশ্বর, কটক ও মেদিনীপুর থেকে ডাক যেতো ইংল্যান্ডে। 
এই পত্রিকাটি প্রকাশনা করছে 'দণ্ডভুক্তি একাডেমী'। সেইসাথে নিয়মিত দণ্ডভুক্তি আলোচনা চলে বিশিষ্ট গবেষকদের নিয়ে। এ পর্যন্ত মোট দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া দ্বিমাসিক ভার্সান হিসেবে পত্রিকার ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার জনপদ, জনজীবন, আঞ্চলিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি নিয়েই বেড়ে উঠেছে দণ্ডভুক্তির কলেবর। বিভিন্ন সংখ্যায় লিখেছেন নলিনী বেরা, সুধীর দত্ত, সূর্য নন্দী, ড. মধুপ দে, ড. বিমল কুমার শীট, ড. দীপক কুমার বড়পণ্ডা, শচীন সাউ, নির্মলেন্দু গুণ, অ্যালবার্ট অশোক, সুধীর মাইতি, তরুণ সিংহ মহাপাত্র, চিন্ময় দাশ, ইয়াসিন পাঠান, অরিন্দম ভৌমিক, বিশ্বজিৎ ঘোষ, অরুন কুমার সাউ, শান্তনু অধিকারী, ভাস্করব্রত পতি প্রমুখ লেখকগণ।

তাম্রলিপ্ত শারদীয়া : পাক্ষিক কাগজ হিসেবে তমলুক শহর থেকে 'তাম্রলিপ্ত' নিয়মিত প্রকাশিত হলেও বছরে একবার 'তাম্রলিপ্ত শারদীয়া' নামে প্রকাশিত হয় পেটভর্তি আঞ্চলিক ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, লােকসংস্কৃতির প্রবন্ধ নিয়ে। জয়দেব মালাকার সম্পাদিত এই পত্রিকাটির আয়তন পশ্চিমবঙ্গে বিরলতম। মূলতঃ মেদিনীপুর জেলার ওপর প্রবন্ধকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। লেখার গুণগত মান এবং প্রাচুর্যতায় এটি হয়ে উঠেছে ঈর্ষণীয় এবং সংগ্রহযােগ্য পত্রিকা। একসময় পত্রিকাটি যুগ্মভাবে সম্পাদনা করতেন অনিল পট্টনায়ক ও জয়দেব মালাকার। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে এখনও প্রকাশিত হয়ে চলেছে পত্রিকাটি। এর রেজিষ্ট্রেশন নম্বর হল- RNINO -27010/74 । পত্রিকাটির মূল বৈশিষ্ট্য হল এর বিশালদেহী আয়তন। ড. কমলকুমার কুণ্ডু, রাধাকৃষ্ণ বাড়ি, ড. পশুপতি প্রসাদ মাহাতাে, ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতি, ভাস্করব্রত পতি, কানাইলাল দাস, জয়দীপ পণ্ডা, সাধনচন্দ্র প্রামাণিক, বনানী মালাকার, রামচন্দ্র ধাড়া, ড. রামরঞ্জন রায়, ড. সুস্নাত জানা, রাজর্ষি মহাপাত্র প্রমুখ নিয়মিত লেখেন এই পত্রিকায়। অতীতে এখানে লিখেছেন মালীবুড়াে, সুশীল কুমার ধাড়া, ইন্দুভূষণ অধিকারী, কুমুদিনী ডাকুয়া, গােপীনন্দন গােস্বামী, রমণীমােহন মাইতি প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ।

দর্শন : মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি সংখ্যায় লেখকসূচির যে তালিকা মেলে তা বেশ শক্তপােক্ত। এঁদের অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত লেখক। ১৯৯৬ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়গপুর থেকে প্রকাশনা শুরু হয়। পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন আভা চক্রবর্তী। মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলার দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানের ইতিহাস, ভ্রমণ ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক বাৎসরিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল 'দর্শন'। সম্পাদকীয় দপ্তর ছিল খড়গপুরেই। সম্প্রতি এই পত্রিকার অন্যতম সহযোগী অভিজিৎ গোস্বামীর মৃত্যু হয়েছে। 

সাহিত্য সম্মেলনী : পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনীর মুখপত্র এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন রাজর্ষি মহাপাত্র এবং কৃতিসুন্দর পাল। অর্ধ বাৎসরিক এই পত্রিকাটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় লােক ঘরানার লেখাকেই। তমলুক থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে। বহু নামিদামি লেখক এখানে নিয়মিত লেখেন। 

ইতিহাস দর্পণ : পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন থেকে স্বপন দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে ২০২০ এর আগষ্টে লক ডাউন পরিস্থিতির মধ্যেই। সহ সম্পাদনায় তনুজা মিশ্র এবং গৌরাঙ্গ পাত্র। প্রধান উপদেষ্টায় আছেন শিবশঙ্কর সেনাপতি। মূলতঃ সর্বভারতীয় আঞ্চলিক ইতিহাস তথা বিকৃত ইতিহাসের সঠিক তথ্যানুসন্ধান করে প্রকাশ করাই এই 'ইতিহাস দর্পণ' পত্রিকার মূল লক্ষ্য। ষান্মাসিক এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় লিখেছেন সূর্য নন্দী, ড. শ্যামল বেরা, চিন্ময় দাশ, সন্তু জানা, শিবশঙ্কর সেনাপতি, ড. কালীপদ প্রধান, ভাস্করব্রত পতি, শান্তিপদ নন্দ, ড. বিমল কুমার শীট, বিশ্বজিৎ ঘোষ, অতনুনন্দন মাইতি এবং স্বপন দাস।
পূর্ব, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা জুড়ে অসংখ্য লোক উপাদান রয়েছে। এসব নিয়ে নিয়মিত লেখেন ঝর্ণা আচার্য্য, চিন্ময় দাশ, লখীন্দর পালোই, তরুণ সিংহ মহাপাত্র, ড. শ্যামল বেরা, অরিন্দম ভৌমিক, ড. মধুপ দে, শান্তিপদ নন্দ, সুদর্শন সেন, জয়দীপ পণ্ডা, রাজর্ষী মহাপাত্র, ড. দীপক কুমার বড়পণ্ডা, ড. প্রবালকান্তি হাজরা, সুধাংশু শেখর ভট্টাচার্য, নরেশ জানা, ভাস্করব্রত পতি, সন্তু জানা, ফিরোজ খান, অতনুনন্দন মাইতি, সুগত পাইন, ড. অসীম কুমার মান্না, রোহিনী নাথ মঙ্গল, পার্থসারথি দাস, অরুণ কুমার সাউ প্রমুখ লেখকগণ। এঁদের লেখাতেই সমৃদ্ধ হয় এইসব লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক পত্রপত্রিকাগুলি। গত কয়েক বছর ধরে চলছে পত্রিকা প্রকাশে তুমুল মন্দা। আর্থিক অনটন আর উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লিটল ম্যাগাজিন জগতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আর বিশেষ এই শ্রেনীর পত্রপত্রিকা প্রকাশের পর ক্রেতা পাওয়াও দুষ্কর। তবুও চলছে। তবুও চলবে।

ছবি - মেহবুব গায়েন 

•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Wednesday, 9 October 2024

মুক্ত গদ্য

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 

পিয়াংকী’র মুক্ত গদ্য 

সন্দেহ এবং একটি বিরল চন্দ্রগ্রহণ 
 

প্রত্নতত্ত্ব আর গোলাপি বিকেল -- এই শিরোনামে গচ্ছিত আছে নিজস্ব জেহাদ। মুদ্রার দুই পিঠ পরস্পরের দিকে তর্জনী রেখে জানিয়েছে তাঁরা সঙ্গমরত । এই সময় 'বাবরের মাথার দাম কত' এ' প্রশ্ন খানিক বেহায়া। 
অরক্ষিত প্রত্নস্থানে এখন ম্যানগ্রোভ। বাড়বাড়ন্ত বোঝে না ওরা, ফলত ছেঁড়া পাতাগুলোয় জমিয়েছে অসুখ। দিন খসে যেভাবে চান্দ্রমাস বিলাসী হয়, ঠিক সেভাবেই ওরা গুনে রাখে কড়ি। গলগ্রহ হলে কুলুঙ্গি থেকে নামিয়ে আনে তেজপাতাগাছ । থমকাই। দাঁড়াই। আদর দিয়ে ঢেকে নিই ঠোঁটের ওপরের অস্পষ্ট তিল। খারাপ লাগে না। ভয় হয় না। ব্রহ্ম আসেন। পুড়ে যাই।নড়ে বসি ফেরবার। ফেরৎ দিই গত হওয়া জন্ম। 
অপ্রিয়'র পাশে দাঁড়াতে বুকের ঝাঁপ খুলতে হয়।খুলি।তেমন আর কীইবা কষ্ট, বড় কথা হল, না ভাবলে কষ্ট সাধারণ। তাকে আঘাত দিয়ে মোড়া বিলাসিতা। দিব্যময়ূর ডেকে যায় খাখা দুপুরে।কলাবনে আগুন লাগে। 'মরুক গে' বলে শিরচ্ছেদ করতে বিবেক কাঁপে, ফলত আগলাই।আগলানো কি জনসেবা? প্রশ্ন করি নিজেকে। ধারাপাত জুড়ে গুণের বৃষ্টি নামে। প্রিয়জনকে বলি, " গুণ বড্ড তাড়াহুড়ো দেয়, আমি বরং যোগ হই"? সে হাসে। তীব্রডাহুক এবং ডাকবজ্র উভয়ই বস্ত্রহরণ পর্বে এসে ঝুঁকে যায় গাছের দিকে। আদিম চুম্বন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে গাছ তার প্রতি অংশে বাংলা কবিতার বাদল দেখি। ঝিরিঝিরি শব্দ ভুগতে দেয়। বারবার মনে হয় এই ভোগাই ভবিতব্য। পিছল নাচঘরে থোপা থোপা কচুরিপানা। ওর বায়ু আছে, নিজের। যার স্বআয়োজন থাকে সে তো ধনী। এই যেমন বাংলা কবিতা, নিজস্ব নদী আছে তাঁর, গাছ আছে পাহাড়ও আছে। উভচরের ওজন নিয়ে আহ্লাদ হয়ে বেঁচে আছে সে। কৈফিয়ৎ নেই, পূর্ণচ্ছেদও না। ভিনিভিনি খুশবু। আরামদায়ক। কবিতা লিখে উল্লাস আর অনৃত দম্পতি, এ যেন দ্রাক্ষাক্ষেতের ভুল । বুঝি কিছু,কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাকি দুই-চতুর্থাংশও হয়তোবা একদিন... 

নকল বড়শি এবং মাছমাছ খেলা। ডুবুরির কানে জল। পরমায়ু পেয়েছে যে আর্য তাঁর কপাল জুড়ে রাত সাড়ে তিনটের অরা। ছোট কাঁটা চারঘর ছুঁলেই রাজহাঁস ডাকবে, আমরা একসাথে আরেকটি বর্তমানের ঘোমটা তুলব।অপেক্ষা করি। সবিনয় নিবেদন বলে আজ যে শুরু করলাম একদিন তাই-ই প্রত্নতত্ত্ব হবে। কোনো এক গোলাপি বিকেলে খবর যাবে স্মৃতিখোর-এর ঘরে। এরই মাঝে সামান্য কিছু তুলে রাখা। 


" তুমি দিয়েছিলে যে পদ্মবন
নাব্যতা ক্রমেই কমে আসছে 
এখন দরকষাকষির সময় 
যার যতটুকু আছে , 
ফতুর হবার আগে ঘোষণা করো সাম্যবাদ
বিপর্যয় আসে আচমকা 
জলস্তর মাপার আগে তাই পিটিয়ে নিতে হয় নৌকার তক্তা 

নদীজন্ম দিয়েছ বলেই এখনো আতসকাচে আয়ুরেখাদের বাড়বাড়ন্ত 
ফুসমন্তরে উধাও করেছ যাবতীয় অভাব হায়রোগ্লিফিকে তাই পদ্মবন 
রোহিণী নক্ষত্রে অবাধ্যসন্ধ্যা 

নাব্যতাকে ব্যবহার করেছে যারা --
তারা জানে না 

যজ্ঞকুণ্ড হল সাপের খোলসের গায়ে ঈশ্বরীর অবিন্যস্ত ঘুম "
(স্বরচিত) 


-- ওপারে যুবতী। ক্ষুদ্রস্তন। কুন্দবোঁটায় গনতন্ত্রের নিমফল। তাঁকে সন্দেহ করে কিনে এনেছি বাংলা কবিতার কিছু উচ্ছিষ্ট সুখ। আমি এঁটোতেই সুখী বলে যারা যারা সাহসী হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকে চোখে সেই যুবতী পেয়েছে নিখুঁত অ্যারিথমেটিক।
' অকারণ অমাবস্যার দিকে ' ধেয়ে গেছে ঈষৎ পোয়াতি কবিতার শুক্রাণু। অক্ষতযোনি পার হতে গেলে 'মধ্যযামের আলো'তে গোটাতে হয় লাটাই। অত:পর ' ভাঙা চশমায় জোনাকি' সমেত বিক্রি হয় লজ্জাবনের ঋতপ্রেম। 

চুরাশিলক্ষ সন্দেহের পর একটি বিরল চন্দ্রগ্রহণ। অসহায় জাতক-জাতিকার গন্ধ নাও বাংলা কবিতা। তুমি ঘনিষ্ঠ ছিলে বলে পড়া হয়নি সরিসৃপের বংশবিস্তার। তিনহাত সংস্থান রেখে এইমুহূর্তে 'এসো ছুঁয়ে দাও নিরাময় '... 


ছবি- মেহবুব গায়েন 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Thursday, 3 October 2024

মুক্ত গদ্য

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 
তীর্থঙ্কর সুমিতের মুক্ত গদ্য 


নদী কথায় ভেসে যায় .....
             

কত জমানো কথা ভেসে যায় নদী বুকে।কেউ খবর রাখেনা।কোনো গল্পের শেষ হয়না। শেষ হয় কথার।ওখানেই শুরু হয় নতুন গল্পের।নতুন থেকে চিরনতুন হতে হতে আটকে যায় চোখ।সেই চোখ থেকে সৃষ্টি হয় এক একটা গঙ্গা,এক একটা পদ্মা।ভালো থাকার লড়াইয়ে জলের স্রোতে ভেসে যায় অব্যাক্ত কত কথার যন্ত্রণা।হয়তো এভাবেই সৃষ্টি হয় কয়েকটা কথা, কয়েকটা চিহ্ন আর এক একটা মরুভূমি...                                     
প্রতিটা দিন কেটে যায় রাতের আঁধার বুকে নিয়ে।কবিরা জন্ম দেয় হাজারো কবিতার।সময়ের সাথে সাথে সময়কে বুকে নিয়ে ফিরে আসে ঢেউ।আজকের প্রশ্ন আগামী কাল পুরনো।নতুন থেকে চিরোনতুনের সন্ধানে আমরা সকলে । কখন যেনো একের পিঠে বহু শূন্য নিয়ে ওজন বাড়াই ।নিজের অচিরেই ফাঁকা হতে হতে কখনো আবার নদীর সাথে মিশে যাই ।গঙ্গা ,পদ্মার বুকে লিখে রাখা এক একটা যন্ত্রণা কত নষ্টা মেয়েকে সতীত্ব দিয়েছে।আর আমি নতুন হতে হতে কখন যেনো ঢেউ এর সন্ধান পেয়েছি।
নদীটা রোজ দেখি বয়ে যায় নিজের মতো।
হাজার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নদী বয়ে যায় নিজের গন্তব্য স্থলে।এই গন্তব্য কোথায় আমরা কেউ জানিনা।তবুও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।তার গন্তব্যের দিকে।কিছু বোঝার আগেই শত ঢেউ ভিজিয়ে দেয় আমাদের।এভাবেই কত কথা ঢেউয়ের স্রোতে হারিয়ে যায়।কত লাল সাদা হয়ে ওঠে।ফিরে আসে তোমার আমার
নদী স্রোতে ভেসে যায় কত কথা...
বলতে বলতে বলাটাই বাকি থেকে যায়,প্রতিদিনের আশ্চর্যতা মূলত ভাবায় না কাউকে।শুধু আঙ্গুলের পরিবর্তন। কথার সাথে বিন্দু পরিবর্তন হতে হতে কখন যে বৃত্ত ছেড়ে বেড়িয়ে গেছে বহুদূর।কেউ খবর রাখেনা।খবর রাখে স্রোতস্বিনী নদী তার ঢেউ হারিয়ে চুপ করে বসে আছে।কিন্তু তা ক্ষণিকের আবার ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়েছে পাড়।এভাবেই নদী আমায় গল্প শোনায় প্রতিদিন।আমি ভেসে যাই নদী বুকে বহু বহুদূর ...
বহুদূর নয়।ঠিক যতটা দূর ভাবি ততটাও নয়।তবুও সবাই বলে অনেক অনেক দূর।কখনো কখনো আমিও তাই ভাবি। কিন্তু ভাবনার ইতি ঘটতে না ঘটতে,আবার নতুন সংগ্রামে ভেসে গেছে কত কথা ।হয়তো এইভাবেই এক একটা দিন কেটে হয় রাত্রি।আর রাতের অাঁধারে লুকিয়ে থাকে দিনের কাব্যকথা ।যে নদী বয়ে গেছে বহুদূর তার ঠিকানা আমরা কেউ রাখিনা।তবু প্রতিটা ঘরে তার বয়ে যাওয়ার স্মৃতি চিহ্ন লুকিয়ে থাকে।যে ভাবে নদী বয়ে যায় ঠিক সেভাবেই ফিরে আসে প্রতিদিনের অবাধ্য কিছু যন্ত্রণা ।তবে সব ই ক্ষণস্থায়ী ।
আর বেঁচে থাকার মানে ...
কথার সাথে সাথে কথারা বদলে যায়।দুপুরের রোদ গায়ে মেখে ভোরের কাকটা 
বাড়ি ফেরে ক্লান্ত হয়ে।ঘরের সাথে সাথে ঘর বদলে যায়।নতুন নতুন মুখ খুঁজে ফেরে চিরনতুনের সন্ধানে।গল্প কথায় সাজিয়ে নেয় তথ্য।আর ফিরে আসে কিছু অবাধ্য যন্ত্রণা।যেখানে জন্ম হয় এক একটা কবির।আবার ফিরে পাওয়া মুহূর্তে নদী কথায় ফিরে আসে প্রতিদিনের বেঁচে থাকার মানে।যে নদী স্রোত হারিয়েছে সে নদীর গভীরে যেওনা ...
সময়ের সাথে সাথে সময় বদলে যায়।মুহূর্তের সাথে মুহুর্ত।সবাই কথা রাখে। শুধু সময় পেরিয়ে গেলে ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে । তাইতো ফাঁকা পথেও কথায় যেনো একটা জট। জটের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমার পৃথিবী।জল আলো বায়ু সবই আছে।শুধু হারানো দিনগুলো আর নেই।নেই কোনো সীমাবদ্ধতার লড়াই।সবাই মুক্ত ।মুক্ত পৃথিবীর কথা আমরা সবাই জানি।কবি , গল্পকার , পবন্ধকার সবাই সাজিয়ে নেয় তাঁর পৃথিবীকে। আমার কল্পনায় হৃদয় ভেসে যায় __ গঙ্গা,মেঘনা,পদ্মার দিকে ...
যে পথটা বেঁকে গেছে সে পথটাই মনে হয় সবথেকে সোজা ছিল।বহুদিন আগে যে রাস্তা হারিয়ে গেছে,সে রাস্তার ই আজ বড় প্রয়োজন।কয়েকটা অক্ষর কি কয়েকটা চিহ্ন কখনো ই রাস্তার গল্প শোনায় না। শোনায় না ফেলে আসা নদী বাঁকের গল্প। যে গল্পে দুপুরের রোদ বিকালের ধুলো আর রাতের ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে।তাইতো আমি গঙ্গার কাঁধে মাথা রেখে পদ্মাকে দেখি।আর মেঘনার গল্পে ব্রহ্মপুত্রর রূপ খুঁজি।
অক্ষরগুলো মনে হয় এইভাবেই হারিয়ে যায় মানুষের জীবন থেকে।সাদা কালো সব ই রং মাত্র।আর হারিয়ে না যাওয়ার কারণ নেই কোনো।শুধু হাততালি আর পুরস্কার কখনই সঠিক পথের সন্ধান দেয়না।ফেলে আসা স্মৃতি আর অভ্যাস একে অপরের পরিপূরক।তাইতো গানের সাথে গান,পথের সাথে পথ লুকিয়ে থাকে প্রতিটা অক্ষর বিন্যাসে।আর এখানেই সৃষ্টি হয় এক একটা নদীকথা।যেখানে সব স্রোতের পথ চলা শুরু ...
যে নদীটা রোজ দেখি বয়ে যেতে তাকে নিয়েই মানুষের যত প্রশ্ন।সকাল থেকে রাত যত ভাবনা,অনুশোচনা,ক্রমশ ভালো লাগার তাগিদ আবার নানা প্রশ্ন।এভাবেই দিন চলে যায়।কেউ এর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করে না।কোনো কারণ ছাড়াই অকারণে নানা কথা।যুক্তিগুলো কে পাশাপাশি সাজিয়ে নতুন হয়ে ওঠা।এভাবে কি কিছু ফিরে আসে? 
যখন একা দাঁড়াই রাস্তায়।মনে হয় কত রাস্তা মিশে গেছে এপাশ থেকে ওপাশ।ওপাশ থেকে এপাশ।ভালো লাগা কি না লাগার সূত্র ধরে ক্রমশ এগিয়ে যাই।আরো রাস্তার খোঁজে ।শেষ কোথায় কেউ জানিনা।তবুও শেষের নেশায় শুরুকে খুঁজি প্রতিদিন।আর হারিয়ে যাই কোনো নদীর বুকে। যার স্রোত প্রতিনিয়ত আমায় ভেজায়। যার পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলি।
যে কথাগুলো অনেকদিন আগে বলার ছিল।সে কথাগুলো বলা হয়েছে।গভীর থেকে গভীর ভাবে।শুধু বলার প্রয়োজনীয়তা থেকে অপ্রয়াজনীয়তায় ব্যাবহার হয়েছে বেশি। অক্ষর চিহ্ন আরো কত কি?ভেসে গেছে কথামালা ।তবুও বদল হয়নি মুহুর্ত।শুধু বদলেছে সময়।বহুদিনের ব্যার্থতার ইতিহাস আজকে অব্যার্থ চাহিদার সাথে হুবহু মিল।যে পথ বেঁকে যেতে যেতে বাঁক নিয়েছে নদী বুকে,সে পথ ই আজ নদী কথা বলে।

ছবি- মেহবুব গায়েন 

••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Saturday, 28 September 2024

বইয়ের আলোচনা

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব 


গ্রন্থের আলোচনা – শতাব্দী চক্রবর্তী


“সময় তো থাকবে না গো মা কেবল কথা রবে। 

কথা রবে কথা রবে মা গো জগতে কলঙ্ক রবে ।।

ভালো কীবা মন্দ কালী অবশ্য এক দাঁড়া হবে। 

সাগরে যার বিছানা মা শিশিরে তার কি করিবে।।

দুঃখে দুঃখে জরোজরো আর কত মা দুঃখ দিবে।

কেবল ওই দুর্গা নাম শ্যামা নামে কলঙ্ক রটিবে।।”


   বহু পরিচিত এই গানটি সকলেই শুনেছেন এবং বছরের পর বছর ধরে এই গানটি বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে পরিবেশিত হয়ে চলেছে। এই গানের রসধারা যাঁর সৃষ্টি তিনি হলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন। হালিশহরে জন্মেছেন যিনি দুঃখ দারিদ্র্য দৈন্যতা নিয়ে। বালক বয়স থেকেই যিনি মাতৃ আরাধনায় ভাবোন্মত্ত। সেই মানুষটির ওপর আধারিত আমার আজকের আলোচনার বিষয় হল সেই বইটি “রামপ্রসাদ” । ২০২৪ কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলাতে বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশ মাত্রই যা আলোড়ন তুলেছে পাঠক মহলে। 


  লেখক অনুপম মুখোপাধ্যায় সফল হয়েছেন তাঁর গবেষণা ভিত্তিক রামপ্রসাদের জীবন, ভাবনা, কবিত্ব, গায়কী, ভাব সমাধি, গুরুর সান্নিধ্য, গার্হস্থ্য জীবন এবং সংসারের গৃহকোণে থেকে একটি মানুষের শাক্ত আরাধনা তুলে ধরতে। 

   

   লেখককে কুর্নিশ জানাই রামপ্রসাদকে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে দেখিয়েছেন। তার যৌনতা, প্রেম, কবিত্বকে নিখুঁতভাবে পরিবেশন করেছেন। কোনো অলৌকিকতা দেখাননি এক্ষেত্রে। তিনি সাধক রামপ্রসাদ যিনি জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ভরা গঙ্গায় নিজহস্তে তৈরি ও পূজিত কালীমাকে বুকে জড়িয়ে কেবল মাতৃক্রোড়ে ঠাঁই পাবে বলে। স্ত্রী চলে যাবার পর হয়তো আর এই ভবে মন টিকিয়ে রাখার দায় তিনি উপলব্ধি করেননি তাই সলিলেই মাকে আঁকড়ে ধরে অন্য ভুবনে চলে যাবার দিন ঠিক করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি দিয়ে লেখক নিপুণভাবে বিশ্বরূপ দর্শন করালেন। আসলে মানুষ যখন টের পায় সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ঘিরে ধরে এক চেনা পরিবেশ যা চিন্তা ভাবনা ছিঁড়ে অবচেতন মন অবলোকন করতে পারে। তাই হয়েছে রামপ্রসাদের মাধ্যমে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় ও শেষ অধ্যায় মিলে গেল অকৃত্রিমভাবে। 


       মানুষ যখন মন প্রাণ দিয়ে তাঁর অভীষ্ট বস্তুকে পেতে চায় সে অবশ্যই পায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ক্ষেত্রেও তা দেখেছি। তিনি জল আর দুধের মধ্যে খাঁটি দুধটুকু রাজহাঁসের মতো তুলে নিতে মানুষকে নিদান দিয়েছেন। সংসারের মধ্যেও ঈশ্বর ভজা যায়। সেই রকম রামপ্রসাদও তাই গৃহে থেকেও সাধক। যিনি অত মন্ত্রোচ্চারণের সাথে দেবীকে আরাধনা করে না, কেবল ভাবোন্মত্ত হয়ে রাগ রাগিণীতে ভাঙা গলায় গান শুনিয়ে মাকে তৃপ্ত করে। তাঁর সাধনসঙ্গী সর্বাণীকে গ্রাসাচ্ছাদনটুকু তুলে দিতে পারলেই শান্তি পান। যখন কোনো রোজগার নেই তাঁর গান গেয়ে বেড়ানোর দরুণ কোনো কর্মে মন লাগাতে পারতেন না তখন কেবল মায়ের কাছে একটিই প্রার্থনা ‘দু'মুঠো অন্ন তুলে দে মা।’


      যে আরবী ফারসী জানে, ওস্তাদজীর কাছে গান শিখেছে, অঙ্কে উচ্চ মেধাবী তার একটা চাকরি নেই বলে বাবার যখন দুঃখ তখনও তিনি গান লিখে আর গেয়েই বেড়িয়েছেন সচ্চিদানন্দ হৃদয়ে। কিন্তু পেট বড় বালাই তাই ভাগ বাটোয়ারা। 

    তাঁর পান্ডিত্য কিন্তু শুধুমাত্র শ্যামাসংগীতেই সীমাবদ্ধ নয় তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে লিখেছেন “বিদ্যাসুন্দর” যা কাম ও ভক্তির যুগপৎ মিলন। 

  

 “ রামপ্রসাদ”-এ লেখক তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দেখিয়েছেন নিখুঁতভাবে। তৎকালীন খাদ্য সংকট, মুর্শিদাবাদের নবাবের সাথে হিন্দু জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্ক, সাহেবদের অনুপ্রবেশ এবং বাঙালিদের ওপর বর্গী হিন্দুদের বর্বরতা। এ সমস্তের চিত্রায়নের মধ্যে মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন লেখকের নিজস্ব বক্তব্য এবং যা পর্যবসিত হয়েছে বাস্তব নিরিখেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।


      রামপ্রসাদের জীবনের ওপর অনেক রকম লেখা হয়তো হয়েছে, তাঁর জীবন সম্বন্ধে অনেক প্রচলিত কথাও রয়েছে, তার সত্য মিথ্যায় না গিয়ে আমরা যদি একটি মানুষ হিসেবে এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক পরিবেশ প্রেক্ষাপট, ধর্মযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা পেতে চাই অবশ্যই এই বইটি পড়া উচিত। 


বই- রামপ্রসাদ
লেখক– অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক– তবুও প্রয়াস
মূল্য– ₹৩৫০
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Sunday, 22 September 2024

মুক্ত গদ্য

কৃষ্টি কেতাবী পর্ব

নিমাই জানা’র মুক্ত গদ্য



নীল মন্দারমনির যুক্তাক্ষর ও দুমুখো সাপেদের সিগমা বেল্ট


( রক্ত রঙের কফ মেশানো সিগমা বেল্ট << বুকের ৩৬০° চর্মরোগের কঙ্কাল ) মান্দারমনির বিষাক্ত দুমুখো ইয়েলো বেলিড সাপেরা লালার মতো লাল ক্যাসিওপিয়া নিয়ে মৃত্যু গ্রন্থি ছিঁড়ে অ্যানাকোন্ডাদের বাইপোলার উপগ্রহে বসতি স্থাপন করছে মৃতজীবী ঈশ্বরের মতো , নন কিউরেবল ডেল্টা বুকের ওষুধের মত আর কোন নির্ভরযোগ্য আসামি নেই যার দুই হাতে রক্ত তঞ্চনের লাল নীলাভ শিরস্ত্রাণ গুলো খসে খসে পড়ে অভিশাপগ্রস্থ দেবতাদের মতো , আমিষ মাংস চাষীদের মতো নিকোটিন বিক্রি হচ্ছে খোলা রাস্তায় । কালো কাঁচে পা কেটে যাওয়া বলদেরা গোল হয়ে মৃত্যুর মিছিল আর অব্যয় রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে জননহীন সঞ্চারপথ হারিয়ে ক্যালরিমিতিতে মাপছে বিস্তীর্ণ বিভাজিকার অসীম ভগ্নাংশের উপপাতালিক সংবহন তত্ত্বের ( স্ব) । র কার ঈশ্বরকে হত্যা করা যায়, অ্যাসিড ফর্মেসানে তার নিত্যতা ছাল ছাড়িয়ে দেওয়া যায় , ধ্বংস করা যায় না বলে ঈশ্বর গতকাল থেকে কালো কালো কার্বাইড গ্রন্থি ছুঁড়ে দিচ্ছে নীল সূর্যের বিষাক্ত অন্ডকোষের দিকে বৃহদারণ্যক ক্ষত্রিয়ের মতো আমি ছাই ভর্তি উনুনের পাশে বসে আছি গোপনাঙ্গ ঢাকা জীবের লাল কালো ব্রেসিয়ার ভর্তি সুক্ষ্মতন্ত্রের অতি পাশবিক চুম্বকীয় ধাতুর নিঃক্ষত্রিয় মৃত্যুর কম্পন ও জাহাজ ভর্তি আসবাবের তীব্র ষষ্ঠ সংগীতের গায়ত্রী ঘোড়াদের খুরের ধ্বনি শোনাবো বলে ,  এতো গলার কাছে রাখা ধুতুরো ফলের নির্যাস নিঃসৃত বিষাক্ত রসের ডুবানো দুটো পা দিয়ে কাঁচের গুঁড় মিশিয়ে চরিত্রাভিনেতার মতো আপতন কোণের মৃত্যু হয়নি বলে আমিও একাকী জলন্ধর মহাকালের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছি সাধকের তানপুরা এসরাজের ক্যানাইন কালো কুকুরের বিষাক্ত পায়খানা আর ম্যানচেস্টারের পিরামিডের গর্ভে থাকা কোন ভেনিস সেবিকাদের লাল আঙ্গুলের বিষাক্ত নখের ঈ কার  ,  আমি ( ওভারিয়ান সিনড্রোম শিব মন্দির) নিজের মুখের ভেতরের সৃষ্ট দানব ঘা টিকে রক্তস্রোত দিয়ে বেঁধে দিচ্ছি ধর্মোন্মাদ মৃত্যুকামিনী পাখিদের হত্যা রহস্যের ৩২ ইঞ্চি গজ ন্যাকড়ার মতো , এক একটা মুক্তি প্রদানকারী ক্ষত্রিয়ের মৃতদেহের মতো সরীসৃপের মতো রক্তাল্পতা আর কোলোনোস্কপির ভেতরে শুয়ে থাকা মৃতজীবী অন্ধকারের মতো আমার গলার ভিতরের পাঞ্চজন্য বেজে উঠলো দ্বারকা পুরীর মতো , ইউরেনিয়াম ভর্তি জাহাজেরা সারি সারি মৃত গাছের মতো অর্ধবৃত্ত দাঁত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , অ্যাডেনিয়াম ফুল থেকেই একদিন ছাই ভর্তি রাতের ময়ূরাক্ষীরা গন্তব্যহীন ছুঁয়ে রাতের কক্ষপথের অতি দ্রবীভূত উপগ্রহদের মত বিস্ফোরণজনিত একটি বজ্রপাত নিরোধক দ্রব্য পুঁতে রাখে মৃত শিশুর কাছে । শ্মশান থেকে ফিরে আসলেই সকলের পীতগ্রন্থি বড়ো ও পুঁজ, মৃকন্ড ভর্তি হয়ে যায়,  অরুণ চৌধুরীর পোস্টমর্টেম পরবর্তী চোখের ব্যাসার্ধ  চওড়া হয়ে যায় কাঁচের প্লেটের মতো , সকলেই শুক্র গ্রহের লাল ইউরেনিয়াস দ্রবণের কালো তরোয়ালটিকে নিয়ে যুক্তাক্ষর শ্মশান থেকে অ্যাসিড ফস মাদার খেতে খেতে আবসুলিউড জন্ডিসের রোগাক্রান্ত মানুষদের জন্য পৃথিবীর ব্যাসার্ধ মাপতে হয় ( ভার্নিয়ার স্কেলে তিনটি দুগ্ধ গ্রন্থি আছে ),  একটি জন্মান্তর অসুখের নাম নিয়ে আমরা সকলেই মারা যাই , মদ দোকানে নিজের গলাটা বন্ধক দিয়ে আসি পললের ভেতরে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রটি লুকিয়ে রাখি আর প্লাস্টিক কঙ্কালের দোকানে কিনতে থাকি নিজের নাড়ি ভুঁড়ি ,  মাথার ভিতর সব কিলবিল পোকা গুলো হিলিয়ামের অস্থির ছায়ায় রেখা দের মতই মাটির অনেক অতলে জাহান্নাময় বেশ্যা নারীদের অসুখ খুঁজতে খুঁজতে শক্ত জীবাশ্ম নিয়ে আসে , এখানে প্রতিদিন রোজ রাতে জরায়ু বিক্রি হয় । পাইকারি মাছের হাট শেষে পড়ে থাকে অসুস্থ পাকস্থলীর পচন , লালা ঝরা কুকুরের কঙ্কাল সার দেহটাকে আমি দুহাতে ঝুলিয়ে রাখি একটা হোটেলের বাইরের রং ওঠা সাইন বোর্ডটার মত । ( গলাকাটা সাপগুলো আর প্রজনন ক্ষমতা থাকে না ) হোটেলটি ঠিক মৃতজীবী মানুষের পান্ডু রোগের মত চকচক করে ওঠে , যেভাবে শ্মশান থেকে ফিরে আসার পর নিকটাত্মীয়েরা এক এক করে বাড়ি চলে যায় এখানে নির্জন অসুখ আছে বলে প্রতিদিন মধ্যরাত পেরিয়ে একাকী উলঙ্গ ঈশ্বরের কাছে আমি আমার বিছানা পেতে রাখি। কোন কফের ওষুধের আর প্রয়োজন নেই। প্রতিটি মানুষই একদিন মৃত্যু হবে বলে তার পাশে বেশি করে মদের বোতলের মতোই আমি বিষাক্ত সরলরেখা খুঁজছিলাম। লাল দ্রোণাচার্য আছে পৃথিবীর অব্যয় সমূহ ভেঙে পৃথু পুরুষ নেমে আসে, এখানে প্রতিদিন শুক্র গ্রহের মতই দুহাতে মসলাদার রোস্টেড ডিম্বানু খুঁজিতে গিয়ে আমার গর্ভপাত তলপেটে কেউ কামড়ে দিয়েছে রাক্ষসের প্রসাখাবিহীন মুণ্ডমালা দিয়ে , পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা ট্রেন বগির মতো আমার ৪৯ টা খণ্ড একসাথে টেবিলের ওপর ওপর শুয়ে থেকে আমার পিঠের উপরে কেউ শুকনো কিসমিস ছড়াচ্ছিল , আমার পা গুলো খসে পড়ছে, ( আমার হাফ প্যান্টের বদ রক্তের পার্মানেন্ট থিওরিয়াম আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি স্বরবর্ণবিহীন নৌকার ধাতব পৃষ্ঠায়) পোশাকের ভেতর থেকে একটা নরম শূদ্র নারী লাল জিবটাকে কাটতে কাটতে খন্ড করে ছড়িয়ে দিচ্ছে একটা ব্যাসদেবের লাল গলার ভেতরে , ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা ভর্তি গলাটি চকচক করে আমার জন্মের মতো , সব হরিণীদের আমি একাকী লাল কালো কমলালেবুর মত বিষাক্ত যোনির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে এ জন্মের শুক্র তারল্য মাপছিলাম । গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলছি আমার পিতাদের ফিতা কৃমি,  ঠিক শত্রুদের মতো কালো কাঁচ ফল দিয়ে তৈরি এমন সঙ্গম শেখানোর জন্য রাতের সব জরুল ফুলের নৃশংসঘাতকেরা কালো স্টেনলেস চাকু দিয়ে গলার পেছনে শিরাটা কেটে দিতেই কেঁচোর মতো ছটফট করতে করতে আমাকে চন্ডালের মতো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একটা মৃত রুমালের ভেতরে , আমার অসুস্থতারাই একাই নাচতে নাচতে কত্থকের ( আমার একটা মৃত সংবিধান আছে) বিশদ ক্লোরামফেনিকল তথ্য আর ফেরোপিনাম মূত্রের ভেতর দিয়ে নির্গত অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এলবুমিন গুলো উদ্ধারকৃত মাছের সরাইখানা দিয়ে আসবাবপত্রের লাল নোঙর ফেলে আসা ব্রহ্মচর্যদের মতো একাকী ঋকবেদ পড়ছে। আকাশময় অন্ধকারের লীলাময়ী পোশাক থেকে পিশাচিত্রের মত নখ বের করে আমরা খাচ্ছিলাম পায়ুদ্বারের অস্থির জীবাণুর যক্ষা রোগাক্রান্ত যৌনাঙ্গ । ১৪. ৯৬ দৈর্ঘ্যের পরমাত্মা তাদের যোনিময় ধ্বংসের কক্ষপথ থেকে লাল বিষুবরেখায় আমাদের অগস্ত্য কথা শোনাচ্ছেন , বাবা প্রতিদিন রাতে মৃদু বজ্রপাত বিক্রি করতেন ।
শুক্রবার বৃহস্পতিবার আর জন্মাষ্টমী ঠিক ত্রিভুজাকৃতি প্রসূতিকাগারের নাম , ( মহিলা গাইনোকোলজিস্টটি হাওয়াইন গিটার দিয়ে আমাকে চন্দ্রবিন্দুর স্টেরয়েড ও স্টেরয়েডের কৌমাঙ্গ নদীর সিলেবাস পড়াতেন)


ছবি- মেহবুব গায়েন 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••