Wednesday, 7 May 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৫

কিশোর নাগ এর কবিতা -



[] সাঁওতালি জন্ম

এই দেখো রাস্তা চলে গেছে তীব্র দিনরাতের
সময় ধরে নক্ষত্রের প্রান্তে
দ্যুতির অনুগমনে ব্যাপ্ত তিমিরের দরজায় হাত
রাখি শব্দহীন 
সোনালি ফসলের ঘ্রাণে বাজে ঘামের এস্রাজ 
বাঁশি বাজে বাঁশের কোটরে
বাসন্তী বাতাসে ভাসে মহুয়ার গন্ধ
এটা কোন গল্প নয়
এখন স্থাবর-জঙ্গম জুড়ে ফেলে যাওয়া
যুদ্ধক্ষেত্রের মতো নিরীহতা 
এই যে গালে হাত দিয়ে বসে আছো তুমি
ভেতরে একটা সাঁওতালি জন্ম অনবরত ঘুরছে 


[] ক্যানভাস 

সময় কেমন করে তার আদল পাল্টায়
এক এক মুহূর্ত চলে যায় 
ঘ্রাণে ঘ্রাণে রুপোলি বিন্যাসে সূর্য হাসে আকাশে 
জীবনানন্দের সোনালি ডানার চিল 
ঢাল খায় বাতাসে
গভীর নগ্নতার মতো খুলে যায় সব আচ্ছাদন 
আলোরিক্ততায় আবাসিক পাখিদের আচমন
বন্দরের নি:সঙ্গতা থেকে বকেরা উড়ে আসে
ঝরাপাতা থেকে থেকে নাচে আর হাসে
এটা কোন গল্প নয়
দগ্ধ শব্দের জয়
বারান্দা পেরিয়ে তুমুল বসতি গড়ে ওঠে বুকে
মাধবীলতাও দেখে ঝুঁকে 
আজ-কাল-পরশুর আভাস
শিল্পী তুলি নিয়ে এঁকে চলে প্রস্তুত ক্যানভাস


[] একটি অমল উপলব্ধি 

প্রত্যাশিত ফলটুকু সবসময় মেলে না  
কয়েকটুকরো ফানুস ভাসে নীল আকাশে 
যদি তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্নের নীল পরীটা 
ডানা মেলে উড়ে যায় স্বপ্নের ভেতর 
খুঁটে নেয় সোনালি গমের দানা 
(অবশ্য কে চায় এমন পাগল, কবি আর প্রেমিক ছাড়া) 
ইচ্ছে-পূরণ ভীষ্মের মতো যদি হতো 
পাতলা ওড়নার মতো পর্দা চোখের উপর 
'আয় ঘুম আয়, ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি...'
ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল এবং শেষ রাতের চাঁদ 
দেদার বিলচ্ছিল আলো হরির লুটের বাতাসের মতো
এরই মাঝে ঘুম এলো নির্বিবাদী 
অশরীরী নিরুদ্বেগ ইচ্ছেগুলির ধ্যান সমাধি...

অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Monday, 5 May 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৫

ত্রিদিব রায় এর কবিতা -

[] চই চই
     
আয় আয় চই চই
দিঘি জলে চিৎ সাঁতরে এগিয়ে যায় প্রেম 
জলে ভাসা হাঁসের দল
সরে সরে পথ করে দেয় ।
ওপারের ঘাটে বসে নবীন বধূটি
ছাই দিয়ে কাঁসার বাসন মাজে,
ঘোমটা পড়েছে খুলে তার ।
প্রতিবেশী যুবকটি ঘাটে আসে
দুজনেই দুজনের চোখে চোখ রাখে
বধূটি সলজ্জ হাসে। শাপলা ফুলের মত
রাঙা দুটি ঠোঁট তার কেঁপে কেঁপে ওঠে।
যুবক লুকিয়ে হাসি ঝাঁপ দেয় জলে,
তার পর সাঁতার সাঁতার আর
স্নান স্নান জলকেলি ---
নিঝুম মধ্যাহ্ন বেলা 
ভেজা শাড়ি পাশে আসে 
আঙুলে আঙুল ছোঁয়, দূরে যায় ।
বধূটি তাকিয়ে থাকে,
মনে পড়ে যায় তার ফেলে আসা প্রেম।
                  

[] এভাবেই দিন কাটে 
                   
সকাল বেলাতেই একরাশ
এঁঠো বাসন ধূতে বসেছে পুকুর ঘাটে 
দীনু মণ্ডলের কিশোরী মেয়েটি,
রুক্ষ চুলে কতদিন তেল পড়েনি 
গায়ে ছেঁড়া ফাটা ফ্রক ।

খোকা চৌধুরীর কিশোরী মেয়েটি 
জোড়া বিনুনি দুলিয়ে চলেছে ইস্কুলে,
কাঁধে তার বইয়ের ব্যাগ 
শাড়ি ব্লাউজে টগবগে লাবণ্য 
ফুটে উঠেছে জ্বল জ্বল করে।
হেঁটে চলেছে হরিণীর মতো চপল ছন্দে।

দীনু মণ্ডলের মেয়েটি তাকিয়েই থাকে 
তার বাসন মাজা থেমে যায়
চোখের কোণে চিকিয়ে ওঠে জল।
এ ঘটনা নিত্য দিনের,
এরপর সে ঘুঁটে কুড়োতে যাবে
তুলতে হবে কচু শাক কলমি লতা,
ছাগল ছানার সঙ্গে খুনসুটিতেই
কেটে যাবে আধা উপোসী দুপুর।
এভাবেই দিন কাটে, কেটে যায়।
                
[] ভয়
     
দুঃসময়ের ঝরা পাতা উড়ছে  
পাতা কুড়োনি মেয়েরা ঝুপড়ির ধূসর উঠোনে বিষণ্ণ বসে আছে ,
মুখে হাসি নেই।
কতদিন উনুন জ্বলেনি ঘরে।
গোপন আস্তানা থেকে কালো চাদর গায়ে 
বেরিয়ে আসছে ভয়।

মানুষের ঘরে সঞ্চিত চাল ডাল 
তেল নুন টাকা কড়ি সুখ
কারা যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।
শাসক শোনেনি অভিযোগ,
ওদের সময় নেই।
এখন প্রতীক্ষা শুধু 
ভয় মুক্ত নতুন দিনের।
          

অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Friday, 2 May 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৪

শম্পা সরকার ঘোষ এর কবিতা -

[] বিষ রঙ...

গুবরে পোকারা রাত-সীমান্তে ঠেলে নিয়ে চলেছে মন্থনজাত গরল।

ঘন ঝোঁপে সার বেঁধে বসে আছে কুন্ডলীকৃত সরীসৃপ।

চেরা জিভে মেখে নিচ্ছে ঝরা ঘামের গন্ধ।

কেয়াফুলের সুবাসেও ওরা অমৃতা হল না!


তাড়ু বেদেনী বেচাকেনা ছেড়ে দিয়েছে বলেই

ঝাঁপির ভিতর নীলাভ অন্ধকার জমেছে এত!

বিষের মতো থকথকে নীল রঙ।


ডুগডুগির শব্দ শুনলেই মাথাটা দুলতে থাকে অভ‍্যাসে।

ভোর রাতে গৃহস্থ উঠোনে, গলবস্ত্রে সিধে সাজিয়ে বসে আছে।

তারপর, গলা ছেড়ে গাইছে-

"জয় জয় মা মনসা, জয় বিষহরি গো-

বন্দনা করি মাগো মা মনসার চরণে,

জয় জয় মা মনসা..."


[] কাকবলি...

নতুন ধানের আলো চালের গুঁড়িতে তখনও উড়চুঙ্গা পোকার ডিম লেগে।

লক্ষ্মীগাইয়ের বৃন্তগালা দুধে নবান গোলার স্বাদ‌ই আলাদা।


কলার পাতায় নাড়কেল নাড়ু আর সাত রকম ফলমিষ্টি রাখা আছে,

সঙ্গে নবান গোলা দিয়ে কাকবলি প্রথা পালন হবে।

মৃত আত্মার হাতে আর পাতে গড়াবে সেই স্বাদ…


আজ অন্নপূর্ণা এসেছে,

বুড়ো শিবের ঝোলায় নৈবেদ্য দেওয়ার সাধ জন্মান্তরের।


[] গৃহলক্ষ্মী...


ঘাটের পিছল পথে ছায়া ছায়া আনাগোনা,

তালপাতা খসে পড়লেই চমকে ওঠে দাগগুলো।

কাঁখে চেঙারী আর লন্ঠন হাতে হেঁটে যায় গৃহলক্ষ্মী-

কাদাছাপে আরও কেউ কেউ আসে।

ওরা গুহাবাসী, এখনও আদিম -

জনসমক্ষে ছায়া হয়ে যায়।


মাড় আর ভাতের লড়াই চলে মিশকালো খিদের থালায়,

আঁধারে চোখ সয়ে গেলে ; আবার বুজে আসে চোখ!

গৃহলক্ষ্মী কোলে তুলে নেয়-

মুঠো ভরা বীজধান আর একসরা কাদানো মাটি।

অলংকরণ - কনিষ্ক‌ শাসমল‌ 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Thursday, 1 May 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৪

অশোক তরু’র কবিতা -
[] ছআছ

১)

চাঁদ এসে ঢাকে,
ওহ্ !  ছায়ার যৌনতা... 
কে মরে কে মারে  ।। 

২)

জোনাকিরা খোঁজে 
ছায়ার কালো আয়না ।  
আগুনে পোড়াবে ।।

৩)

সব শেষ হল !  
হাত ছেড়ে চলে গেল,
আহা ! বিসর্জন !!  

৪)

ভোর ভেঙে গেল । 
মুছে গেছে প্রসাধন । 
রাতের আসন ।। 

৫)

মুখচরা বালি । 
অবোধ পশুরা জানে
ঘায়েলের পর ।। 

অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Tuesday, 29 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৪

মহম্মদ সামিম এর কবিতা -


[] সম্ভ্রম 

এই কথা স্বীকারে কোনও যন্ত্রণা নেই
একদিন দিগন্তের ওপার থেকে
সূর্যের লাল মুছে
আমাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ফুটে উঠবে।
সেদিন আগুন, নরম তুলোর মতো হয়ে
নিভে যেতে যেতে দূরের নক্ষত্রে মিশে যাবে
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে গাছেদের সম্ভ্রম
সেদিন তুমি ফিরে আসবে নিশ্চয়?
গভীর শ্বাস দিয়ে আমাকে উড়িয়ে দেবে
আর আমি
ছোট ডিঙির উপর দুলে দুলে
ক্রমশ ঘন হয়ে তোমার ভিতর সম্পৃক্ত হয়ে যাব।

[] বর্ম

ছিল না কোনও অসুখ, লুপ্ত অশ্রুর উচ্ছ্বাস
তালুতেই বন্দি ছিল অপার পৃথিবী
কিছুটা বিক্ষত, মুষ্টিবদ্ধ, আঘাতসমূহ
আঁজলা ভরে তুলে আনি আয়ুর নিজস্ব লিপি
মৃত্যুও সবুজ মাঠ, চির উন্মাদ

প্রশ্রয়ের বিভা ছিল তোমার চোখে
আমি অপরাজেয় হতে চাইনি কোনওদিন
আত্মনিবেদন করেছি তোমার নিদ্রাবিলাস

যুদ্ধ শেষে
 চির ঘুমের ভিতর স্বপ্নবন্দনায় রত হয়ে
                                 রয়ে গেছি চিরকাল।


[] অব্যর্থ আলোর শোক 

কী নিপুণ ঘুম,ভঙ্গিটি যেন প্রদীপ শিখা
অনন্ত উদারতা নিয়ে এটুকুই প্রশান্তি
খুব ধীরে ভাতের থালাখানি রাখলেন অশক্ত ভিক্ষুণী
জল ও লবনের নির্লিপ্ত তরল
আটপৌরে জীবনের উপর দিয়ে
বয়ে গেছে কত ঝড় ও বজ্রপাত
আলো নেই তেমন, বাদল মেঘের উপর
জোনাকির শাশ্বত বৈভব
দূরে কোথাও বেজে চলেছে উদাসী সানাই
করুণ দৃষ্টির ভিতর এসে বসেন স্বয়ং ঈশ্বর
খুব ধীরে চোখ মেলে তাকায় অন্ধ কিশোরটি
চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিমা আলোর মণি
দিনান্তের সঞ্চয় বলতে এটুকুই—
ভাতের থালার উপর গড়াগড়ি খায় জীবন

অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Saturday, 26 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৩

রওশান রুবী’র কবিতা -


[] রোদ

কেউ দেখতে পেল না, কেউ না, /

কার্নিসে ঝুলে আছে একফালি রোদ।/

সবাই রোদ খুঁজে আচমকা ভিতরে;/

আমি কার্নিস থেকে রোদটুকু এনে /

আগামীকালের ক্যানভাস উন্মোচিত করি,/

তারা তন্নতন্ন করে খোঁজে আমার ছড়ানো শস্য/

আর শুধু বুনে যায় একার আরাম।/


[] পা

পায়ের কোনও নিজস্ব চাওয়া নেই/

পথ জুড়ে ভিন্ন অভিজ্ঞতা/

ডানে বাঁয়ে তারকাটা, ঘনিষ্ঠ ধূলি/

পেছনে ফেলে সে তোমার জন্য ছোটে,/

তোমার জন্য বিবর্ণমুখ শুষ্ক দিন লুকিয়ে

আকাশটা নুন জলে কেনে।/


পায়ের কোনও বিশেষ চাওয়া নেই/

অন্যের ভিতরে চুপ তার /

ঋতুচক্রের অগণন বাসনা।/


[] আয়না 

আমরা কারো দুঃখ কেউ ছুঁবো না কখনো বলিনি,/

বলিনি বাষ্পিভূত হয়ে যাচ্ছে স্থবির তাপ,/

কিংবা ছাতার ভেতর থাকুন হয়ে ছাতার আসবাব।/


তবুও, আমাদের খুলে যাচ্ছে অহর্নিশ বৃষ্টি কাঁপা ঋতু,/

দূরে যাচ্ছে সেচ্চায় দূরত্বের দ্বিধা,/

মাঝে মাঝে অভিন্ন অন্তরের হাহাকারে বলি,/

আমরা যদি সেই কবি হতে পারতাম/

যে কবি আঙুলে তুলেছেন শিল্পীত সাক্ষর।/


আমাদের কোন ক্যালেন্ডারের প্রিয় তারিখ নেই/

নেই ক্যান্ডেলসন্ধ্যায় উঠা নীল সমুদ্রের উত্তাপ/

আমাদের আরম্ভ নেই, ক্লেদ নেই, নেমে আসা নেই/

যুদ্ধের পর্বত ডিঙিয়ে তবুও বিহ্বল জেগে থাকা।/


রোজ মানচিত্রে খুঁজি প্রতিচ্ছবির ব্যাঞ্জন/

সাতকাহনের সংশয় পেরিয়ে অনুভব ছুঁই/

আমাদের ভয় নেই বলে স্থির বিশ্বাসে বলি-/

‘আমার ভেতর জেগে থাকুন একটা আয়না।’/

মূলত, আয়নাই মানুষের বোধ অবগাহনের মরমিচোখ।/


অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

Thursday, 24 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -৩

দেবার্ঘ সেন এর কবিতা -


[] দাঁড়ি

এ কোন সুর, 
              জ্বালাময়ী
তিলে তিলে কুয়াশা-জীবন।

বাতাসে আজ অপমান বাজে—
কাকের ঠোঁটে মাংসের টুকরো।

ক্রমশ দহন, 
               শরীর টাইম ব্যোম
বেঁধেছি স্বপ্ন, আমার ছায়া
                   ছায়া খুন উল্লাসে।



[] অনুবাত

পর্বত গাল বেয়ে অশ্রু নামছে—
নামছে, পাপড়ি সিক্ত গোধূলি 
                             কাঞ্চনজঙ্ঘায়
অকাল দহন, সমগ্র গিলেছে
আলো কিংবা রোদ, 
যদি বলো, এরপরও তুমি অসহায়।

তুমি নিষ্ঠুর, 
চলে যাও যেদিকে দু'চোখ যায়।


[] স্মার্ট বাজার

তবুও শরীর—
চৈতন্য ছুঁয়ে যাচ্ছে হাওয়ার লিপি।

এখানে তোমার নামে,
আঙুর বাগান।

বোয়মের জলে ভাসে রঙিন মাছ।

রঙ যত ক্ষত
ততই রঙিন।

বাগান ঘুরে দেখি, ভাঙা পেণ্ডুলাম
ফলের কোনও নিরাপত্তা নেই।

শাসন-শূন্য অতনু পৃথিবী
পৃথিবীর কবজিতে, ব্যর্থ; স্মার্ট ওয়াচ।



অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••