Friday, 17 July 2020

কবিতা

শাপলা পর্ব -৩

কবি মলয় পাহাড়ি এর কবিতা-





১।।   ছ'টা পঞ্চাশের সাঁতরাগাছি লোকাল


ছ'টা পঞ্চাশের সাঁতরাগাছি লোকাল আবার কবে চালু হবে , ডাক্তার ? 
হারাধনের ছেলেরা কতোদিন হেফাজতে, সংবাদপত্রে  মুখঢাকা নিজেদের ছবির দিকে চেয়ে পড়ে নিতে চায় - মুখোশের নিচে কোন কোন ধারা, ...গোপন জবানবন্দী, কতোটা খুলেছি নিজেকে , কতোটা খোলা যায় চেয়ারের কাছে ? ডাক্তার, তোমার কাছে ও ?

শিকড় ছিন্ন করার কুঠার ধরিয়ে দিল কে ? 

সে কুঠার কি হাতে আটকেছে ? হস্তরেখায়  কেবলই খুনযাত্রা ! সাঁতরাগাছি লোকাল শঙ্খদূত ভগীরথ হয়ে এসে দাঁড়াবে, আর ভারতীয় রেল কে গালি ছু্ঁড়ে আমি উঠে যাব ভেন্ডারে, খেজুরির কাগজি লেবু বা পটলের পাশে বসে, লাট সাহেবের ছোটোব্যাটা, জলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন বিক্রি  করেছি...
ভায়েদের সাথে প্রতিটি সম্পর্ক ছেদনের আগুন আমার হাতের কুঠারকে ক্লিষ্ট ও কঠোর করেছে, 
আমার ফুসফুসের ভিতর দাগি আগুনের কালো ধোঁয়া, মৃত্যুদণ্ডের ভয়...

আর কী দেখা হবে না বৈরাগী তোমার সাথে, ভেন্ডারে উঠে এসে শোনাবে না নক্ষত্রের গান ! 

তুমি নেমে যাওয়ার পর সাঁতরাগাছি লোকাল আনমনা হয়ে যেত... মনেই পড়ত না মাধুকরীর আধুলি তোমাকে দেওয়া হয়নি, পরে খুব কষ্ট হত, ভোঁতা কুঠারের দুফোঁটা অশ্রু তুমি না নিয়ে চলে গেলে বৈরাগী...





২।।   পাতার আয়ু


এ ঘরে আরো ক'জন আছে, তবু আমি স্কুলের 
 ক্লাস বেল্ শুনছি। মোবাইলের স্ক্রিন থেকে ফোর-জি  ড্রপ করতে করতে একটা চেনা পূর্ণচ্ছেদ হয়ে গেল। কোলাহল থেকে দূরে বনকমলির  ডালে একটা  উড়তি বয়সের  ফিঙে বসে আছে , দুটি পাতার পাশে এসে যেন থেমে গেছে পাখি। লেজে বিঁধে আছে কালো তীর...

আমি আজ ক্ষিদের কথা বলছি না , সবাইকে নিয়ে বাঁচার শ্লোগান মনে পড়ছে না, মহানদীর সবুজ অ্যলগি সরিয়ে  সেই যে বালি স্নান, বন্ধুদের হাতে হাত রেখে ভেজা শপথ, এই দু'কামরার কোয়ারেন্টাইন সবকিছু ভুলিয়ে দেবে, ডাক্তার ?

আমি কেমন নেমে যাচ্ছি , আর আমার ভিতর  শ্রমিকের অবশিষ্ট আয়ু   দুটি পাতা আঁকড়ে নেমে যাচ্ছে... 

ভূঁয়ের উপর কোন পাতাই সবুজ নয় যতক্ষন না সে নাম না জানা কোনো  ঘাস ...





৩।।  কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোর ও হুগলির ডানকুনি



পরিযায়ী পাখির ডানায় নিজের মুখ কোনোদিনও দেখেছো ?

কোনদিনও নিজেকে জলের মুখোমুখি রেখে প্রশ্ন করেছো এ ছায়ামুখ কী কোনো ঘর ছেড়ে আসা নিরন্ন পাখির ? 

যে জলে মুখছবি কেঁপেওঠে, ভেঙে যায় রূপের মিনার, তা থেকে রিমোট ঘুরিয়ে 'প্রিয় তারকার অন্দরমহ'এ  ভারতের মানচিত্র মার্কা রুটি বেলার লীলামুখ দেখা যাক... একটু বেশি চিন্তাশীল হলে সেখান থেকে চলে যাওয়া যেতে পারে দালাল স্ট্রিটের মুখে বসানো বাদামি ষাঁড়টির বিজ্ঞাপিত পেশিগুলির দিকে, সোনালী আভরণের ভিতর শ্রীষণ্ডের সম্মুখ পদযুগল যে বায়বীয়, বুদবুদ ঠাসা-- সে রহস্যভেদের চিন্তামুখ নষ্ট করে ইউটিউব ভাসিয়ে দেয় ঘরোয়া পদ্ধতিতে বিরিয়ানি রান্নার কোমল রেসিপি।

লক-আপ কে লক-ডাউন নামে ডাকলে তোমরা উত্তেজিত হয়ে যাও। তালাচাবির ভিতর প্রতারক শীত-বাতাসে শরীর এলিয়ে কী আকাশের গায়ে পথ   খোঁজা  যায় ? 

 সস্তা কিছু ডেটায়--চশমা দিয়ে স্ক্রিনের ভিতর পৃথিবীকে খুব ছোট দেখায়, কনে বউ এর সাথে ভাজা মাছের সম্পর্কের মতো, লাল রেশমে যেন তাকে মানিয়েছে খুব...

আজ সন্ধে থেকে খুব ভাট বকছি বনমালী, সহজ করে বলা আমার অনায়ত্ব , বৃত্তের গিঁট খুলে জন্ম মাটির কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া কিছু বাকি নেই, আকাশের সমান্তরালে লোহা পাথরের শুকনো রেলপথ, পাশে  কবুল স্বীকার করা একটা বউ, কাঁখে বাচ্চা...

পকেটে শ'দুয়েক ভারতীয় মুদ্রা আছে, থলেতে চার- ছ'টি গমের রুটি, কাঁচালঙ্কা... মাথার উপর যমকাক ডেকে ডেকে উড়ছে, আমরা হেঁটে  চলেছি কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোর বা হুগলির ডানকুনি থেকে... এখনও আমরা অনেকটা মানুষের মতো দেখতে... এখনও আমরা অনেকটা ভোটারের মতো দেখতে...




৪।।   অসম্পূর্ণ আত্মীয়রেখা /১৭



এমন একটা ব্ল্যাক আউট হলে পথের থেকে ঠিকানা সরে যায় । 

দেখি না তাদের, হলদির পলিজল ভেঙে রাতের যে নেয়েরা  উঠে এসেছিল, তাদের কাছে ছিল হাঙরের পাখনার হাড়, শুশ্রূষার দৈব উপকথা  ।

তবু লগির ছাপ বলে দেয় তারা তো  ছিল,                           গঙ্গা-শুশুকের চামড়া দিয়ে বানানো  পোশাক,   জল-পলাশের বিষাদ মাখা ভাঙা দেহ, কালো  নকশাকাটা  মাটির কলস  মন্দারমণি তটে পাওয়া গেছে, এ শহর দিনে দিনে ভুলে গেছে তার  অতীত  পরিব্রাজন, তার নিজস্ব নেয়েরা কাদুয়া তট থেকে প্রেমিকা-রঙের  পাকা বাদামের  ফল নিয়ে ভেসে যেত নরহাটে। দরিয়াপুর লাইট হাউস থেকে তাদের অবয়ব গুলি ঠিকঠাক চিনে নিত মাঝি পাড়ার সিঁদুরে  আলো... 

খড়িমাটির জল দিয়ে নব্য  শাসকেরা পুছে দিয়ে গেছে ফলকের লিপিসমুহ , সংকেত রেখা, বাকলের গায়ে খোদাই করা সাদা বোকামি... 

 চলমান একটা জ্যান্ত সাদা শহর, একটা সাদা ব্ল্যাক -আউট... খড়ির  বিভেদরেখার ওপারে   সেই  অপূর্ব নামের ছেলেটির সহজ আত্মীয়তা, বিষম সন্ধ্যায় বেজে ওঠা সুধা-মঞ্জীর, জীবন লেখার ঝর্ণা কলম , সানুর অসুখ বাড়ি...

জলে এতো রং দিলে পিপাসা কী মেটে ! আমি বালির শরীর ধরে আর্ধেক জীবন কাটিয়েছি, বিশুদ্ধ শুষ্ক ছাড়া ফিরিয়েছি আর সব , আমার শরীরের ভিতর বয়ে যায় ভেজা নদী, পাড়ে লবনাম্বু... 

আমি ফিরে যাব,  ফিরে যাব সাদা জলে ...  
প্রতাপ, সিস্টেমে 'আন-ডু' বাটন কোথায়  খুঁজে দিতে পারো?




৫।।    অসম্পূর্ণ আত্মীয়রেখা /১৪


বালির ঢাল জুড়ে বাদামের গাছ। আশেপাশে বাহার রঙে  ইতিউতি নৌকোবাড়ি, রাজা আজ সভায় আসবেন না , মন্ত্রী, সেনাধ্যক্ষ কোনো অদৃশ্য মিনার থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন শহরের চলাচল ...

আজ ঘোড়দৌড় বন্ধ, আস্তাবলের দরজা খুলে মুক্ত ঘোড়ারা বালির চরে ঘুরে ফিরে বাতাসের লোনা গন্ধ মাখে ,  আজ  কেউ সাজিয়ে দেবে না যুদ্ধের জন্য, আজ বালির টোপায় জমে থাকা স্থির জলে নিজেদের মুখছায়া দেখে ভুলে যাবে গতযুদ্ধের  ক্ষত বা বিয়োগব্যাথা ...

ভোররাতে চাঁদের জলে শহর ধোয়া হয়েছে , শহরের কিশোরীরা নরম রোদে গাছেদের আদরে পূর্ণ করলে  ফুল-পাতার রানীসাজ পায়, তখন পুরুষেরা হাঁটু  মুড়ে স্বীকার করে যে যার অপরাধের কথা... 

মুকুট, পোশাক খুলে, টিলার অদূরে, অজান্তে  এসে বসে থাকেন রাজা, তাঁর  চোখে 
দেখা যায় শহরের অন্তর, ঘোড়াটির মুগ্ধতার  মতো...


অলংকরণ - দিশা সেনগুপ্ত

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments:

Post a Comment