Sunday, 21 February 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-১

কবি জাকির হোসেন স্মৃতিজিৎ এর কবিতা-




১.

   ∆ জন্মপিপাসা ∆



আমাকে ঘিরে রেখেছে সৃষ্টিবিস্ময় 
দু’চোখে অনন্ত তৃষ্ণার আলপনা
আমি দেখতে পাচ্ছি, এক হাতে জোনাকি আর
অন্য হাতে নক্ষত্র-লণ্ঠন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাত্রি-রানার
এক ছায়াপথ থেকে অন্য ছায়াপথে 
লাফিয়ে নামছে শিকারী কালোবেড়াল
আমার সামনে করুণ চোখে দাঁড়িয়ে আছে 
ব্রহ্মাণ্ডের ঝুলি ও আলোর আলখাল্লা

চারপাশে এত জন্মপিপাসা 
রজঃস্বলা পৃথিবীর কাছে জানু পেতে বসে আছে




২.

 ∆ আমি আছি বলে ∆


আমি আছি বলেই প্রকৃতিতে রহস্য আছে
ভূবনময় আলো আছে
পিতামহ গাছ আছে 
পারিজাত ফুল আছে 
বেহেস্তি ফল আছে
নীলকণ্ঠ পাখি আছে 
গেরস্থালি শস্য আছে 
তোমাকে নতুন করে পাবার প্রাণময় বীর্য আছে 

আমি আছি বলেই নওল কিশোর সূর্য ওঠে
বালিশের মত নরম রাত্রি আসে
শাদা ঘোড়ার কেশরের মত উল্লসিত দিন আসে
ভোরের বাগানে কিশোরীর নূপুরের মত শব্দের ফুল ফোটে 

সীমান্ত চৌকিতে বসে  যখন দুই বাংলারর কবিতা পড়ি
তখন চোখের জলে গলে যেতে থাকে বিভেদের কাঁটাতার ..



৩.


∆ মৃত্যু পরবর্তী ∆



তবুও মৃত্যু ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলে চলে যায়
মেঘের গায়ে বিদ্যুৎ চমকালে বুকের বাঁ-দিক চিনচিন করে
মরে যাওয়া শ্রেয় জেনেও মনে হয় 
আর কিছুদিন বেঁচে থাকা কী ভীষণ জরুরী....

ভোরে ঘুম ভাঙলে মনে হয় ‘আজও বেঁচে আছি' 
এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কী হতে পারে ?
আজ রাতে ঘুমের ভেতর কত মানুষ মরে গেছে
আমিও মরে যেতে পারতাম 
মরে গেলেও ভোর হত
বারান্দার টবটায় আর একটা সূর্যমুখী পাপড়ি মেলত
আমি যে আপিসে রোজ যাই
সেখানে এক মিনিট নীরবতা পালন হত
পরের দিন থেকে আবার সব আগের মত
একটা বর্ষা এসে মুছে দিত মাঠের শোক 
আর গিন্নির পাশবালিশ
আমার মৃত্যুতে কারও কিছুই তো যায় আসে না
তবু কার জন্য এত বেঁচে থাকার তীব্র আকুলতা 
নিজেকে ভালোবাসার স্বার্থপরতা থেকে 
আমিও বেরিয়ে আসতে পারিনা ...



৪.

∆ আত্মরক্ষার প্রেসক্রিপশন ∆


তবু অন্ধকার ও একা এক ল্যাম্পপোস্টের সাথে রোজ কথা হয় 
যদিও আমরা কেউই নিজের সামর্থ্য পেরোতে পারি না

'ধর্ম' বুঝি না বলে মন্দির-মসজিদের কাছে ঘেষি না 
তবু চোখে সবুজ-লাল কাপড় বেঁধে আসতে বলে মোল্লাপুরোহিত
'রাজনীতি' বুঝি না বলে দূরে সরে থাকি
তবু ডাণ্ডায় পতাকা বেঁধে হাতে ধরিয়ে দেয় –
তিনবার মাধ্যমিক ফেল-করা পাড়ার ডাকাবুকো নেতা

মানুষকে জুম্বি বানিয়ে মানুষের পেছনে লেলিয়ে দিচ্ছে যারা
তাদের সমর্থন না করলে পেছনে সেঁটে দেবে ‘দেশদ্রোহী’ 
কিংবা ‘মাওবাদী’ তকমা
কোন্ ইজমের প্রেসক্রিপশনে যে আত্মরক্ষার 
সুড়ঙ্গ আছে জানি না
তাই পরস্পর নীচু স্বরে কথা বলি আমরা

এইসব গোপন কথকতার ভেতর কারো অনুপ্রবেশ মঞ্জুর নয়
পথভোলা ধুমকেতুর তোয়াক্কা না করে 
গূঢ় অন্ধকারে একা ল্যাম্পপোস্টের সাথে কথা হয়...



৫.

∆ ল্যাম্পপোস্ট : ভিখেরি ও মজুতদার ∆



ভিখেরি দেখলে এখনও ল্যাম্পপোস্টটির কথা মনে পড়ে
মজুতদার ও চাচানেহেরুর কথা 
আজ পর্যন্ত কোনো মজুতদারকে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো যায়নি
বরং ক্ষুধাসূচক ল্যাম্পপোস্ট ছাড়িয়ে উঠতে থাকে…
ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পেটের মত নেমে যায় জাতীয় আয়
ক্ষুধার্ত শিশুকে মনুমেন্টের চূড়া দেখিয়ে ‘মা’ বলে, 
‘দেখো আমরা বাড়ছি খোকা !'

আমরা কেউই নিজের সামর্থ্য পেরোতে পারি না
তাই ইঁদারার গায়ে হেলান দিয়ে যে ভিখিরি 
এক রাতের রাজা হতে চায় 
আমরা তার পয়সার থালায় মৌন আলো ফেলি 
নক্ষত্রের মার্সিডিজ-বিন্যাস লজ্জা পেয়ে ফিরে যায় উচ্চ গ্যালাক্সিতে




ক্যামেরা- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

1 comment:

  1. দ্বিতীয় কবিতার শেষ চার লাইন সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল।

    ReplyDelete