কৃষ্টি কেতাবী পর্ব
গ্রন্থের আলোচনা – শতাব্দী চক্রবর্তী
“সময় তো থাকবে না গো মা কেবল কথা রবে।
কথা রবে কথা রবে মা গো জগতে কলঙ্ক রবে ।।
ভালো কীবা মন্দ কালী অবশ্য এক দাঁড়া হবে।
সাগরে যার বিছানা মা শিশিরে তার কি করিবে।।
দুঃখে দুঃখে জরোজরো আর কত মা দুঃখ দিবে।
কেবল ওই দুর্গা নাম শ্যামা নামে কলঙ্ক রটিবে।।”
বহু পরিচিত এই গানটি সকলেই শুনেছেন এবং বছরের পর বছর ধরে এই গানটি বিভিন্ন শিল্পীর কন্ঠে পরিবেশিত হয়ে চলেছে। এই গানের রসধারা যাঁর সৃষ্টি তিনি হলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন। হালিশহরে জন্মেছেন যিনি দুঃখ দারিদ্র্য দৈন্যতা নিয়ে। বালক বয়স থেকেই যিনি মাতৃ আরাধনায় ভাবোন্মত্ত। সেই মানুষটির ওপর আধারিত আমার আজকের আলোচনার বিষয় হল সেই বইটি “রামপ্রসাদ” । ২০২৪ কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলাতে বইটি প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশ মাত্রই যা আলোড়ন তুলেছে পাঠক মহলে।
লেখক অনুপম মুখোপাধ্যায় সফল হয়েছেন তাঁর গবেষণা ভিত্তিক রামপ্রসাদের জীবন, ভাবনা, কবিত্ব, গায়কী, ভাব সমাধি, গুরুর সান্নিধ্য, গার্হস্থ্য জীবন এবং সংসারের গৃহকোণে থেকে একটি মানুষের শাক্ত আরাধনা তুলে ধরতে।
লেখককে কুর্নিশ জানাই রামপ্রসাদকে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসেবে দেখিয়েছেন। তার যৌনতা, প্রেম, কবিত্বকে নিখুঁতভাবে পরিবেশন করেছেন। কোনো অলৌকিকতা দেখাননি এক্ষেত্রে। তিনি সাধক রামপ্রসাদ যিনি জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ভরা গঙ্গায় নিজহস্তে তৈরি ও পূজিত কালীমাকে বুকে জড়িয়ে কেবল মাতৃক্রোড়ে ঠাঁই পাবে বলে। স্ত্রী চলে যাবার পর হয়তো আর এই ভবে মন টিকিয়ে রাখার দায় তিনি উপলব্ধি করেননি তাই সলিলেই মাকে আঁকড়ে ধরে অন্য ভুবনে চলে যাবার দিন ঠিক করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি দিয়ে লেখক নিপুণভাবে বিশ্বরূপ দর্শন করালেন। আসলে মানুষ যখন টের পায় সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন ঘিরে ধরে এক চেনা পরিবেশ যা চিন্তা ভাবনা ছিঁড়ে অবচেতন মন অবলোকন করতে পারে। তাই হয়েছে রামপ্রসাদের মাধ্যমে। উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় ও শেষ অধ্যায় মিলে গেল অকৃত্রিমভাবে।
মানুষ যখন মন প্রাণ দিয়ে তাঁর অভীষ্ট বস্তুকে পেতে চায় সে অবশ্যই পায়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ক্ষেত্রেও তা দেখেছি। তিনি জল আর দুধের মধ্যে খাঁটি দুধটুকু রাজহাঁসের মতো তুলে নিতে মানুষকে নিদান দিয়েছেন। সংসারের মধ্যেও ঈশ্বর ভজা যায়। সেই রকম রামপ্রসাদও তাই গৃহে থেকেও সাধক। যিনি অত মন্ত্রোচ্চারণের সাথে দেবীকে আরাধনা করে না, কেবল ভাবোন্মত্ত হয়ে রাগ রাগিণীতে ভাঙা গলায় গান শুনিয়ে মাকে তৃপ্ত করে। তাঁর সাধনসঙ্গী সর্বাণীকে গ্রাসাচ্ছাদনটুকু তুলে দিতে পারলেই শান্তি পান। যখন কোনো রোজগার নেই তাঁর গান গেয়ে বেড়ানোর দরুণ কোনো কর্মে মন লাগাতে পারতেন না তখন কেবল মায়ের কাছে একটিই প্রার্থনা ‘দু'মুঠো অন্ন তুলে দে মা।’
যে আরবী ফারসী জানে, ওস্তাদজীর কাছে গান শিখেছে, অঙ্কে উচ্চ মেধাবী তার একটা চাকরি নেই বলে বাবার যখন দুঃখ তখনও তিনি গান লিখে আর গেয়েই বেড়িয়েছেন সচ্চিদানন্দ হৃদয়ে। কিন্তু পেট বড় বালাই তাই ভাগ বাটোয়ারা।
তাঁর পান্ডিত্য কিন্তু শুধুমাত্র শ্যামাসংগীতেই সীমাবদ্ধ নয় তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধে লিখেছেন “বিদ্যাসুন্দর” যা কাম ও ভক্তির যুগপৎ মিলন।
“ রামপ্রসাদ”-এ লেখক তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে দেখিয়েছেন নিখুঁতভাবে। তৎকালীন খাদ্য সংকট, মুর্শিদাবাদের নবাবের সাথে হিন্দু জমিদার কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পর্ক, সাহেবদের অনুপ্রবেশ এবং বাঙালিদের ওপর বর্গী হিন্দুদের বর্বরতা। এ সমস্তের চিত্রায়নের মধ্যে মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন লেখকের নিজস্ব বক্তব্য এবং যা পর্যবসিত হয়েছে বাস্তব নিরিখেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
রামপ্রসাদের জীবনের ওপর অনেক রকম লেখা হয়তো হয়েছে, তাঁর জীবন সম্বন্ধে অনেক প্রচলিত কথাও রয়েছে, তার সত্য মিথ্যায় না গিয়ে আমরা যদি একটি মানুষ হিসেবে এবং তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক পরিবেশ প্রেক্ষাপট, ধর্মযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা পেতে চাই অবশ্যই এই বইটি পড়া উচিত।
বই- রামপ্রসাদ
লেখক– অনুপম মুখোপাধ্যায়
প্রকাশক– তবুও প্রয়াস
মূল্য– ₹৩৫০
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
No comments:
Post a Comment