Sunday, 13 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -১

সৌমাল্য গরাই‌ এর কবিতা -

[] জননী 

আমাকে পুরোটা গিলে নেবার পর
শাদা কাপড়ে ঢেকে বলা হয়েছিল- ভালো হবে
শূন্যে ছোঁড়া দু একটা ফায়ারিং, 
ছুটে এসে হাতকড়া পরিয়েছিল চলমানতায়
ফাটকের ভঙ্গুর রেখাতে লেখা ছিল তোমাকে খোঁজার সংকেত
পকেটে খুচরো নোটের ছাপ, দু এক গাছি লম্বা চুল
চিরুনির কাছে তল্লাশি হয়ে ঝুঁকেছিল
শুকনো গালে নরম অমসৃণ হাসি, নির্বান্ধব কান্নায়
তোমাকে দেখা গিয়েছিল বোরখার আড়ালে, চরম ব্যস্ততায় 
জীবিত ও মৃত, দুই সন্তান লালন-পালনে

[] সংসার 

ঝড় আসে, কত মৃত্যু হয়ে গেছ পার... 

সন্ধ্যা নামে, শাঁখের আওয়াজ শুনে দূর—
আকাশে যখনি জ্বেলে দাও লক্ষ তারা
সবার অলক্ষ্যে ভাবি, এভাবে অনন্তকাল 
চলে যাবে, দুজনের নতুন সংসার..


[] শিখণ্ডী 

পোড়া জতুগৃহের নিকটে   জমে থাকা ছাই
তুলে আনে দায়ভার, মহাযজ্ঞশালার বিজনে
খেলাকে ঘুরিয়ে দিয়ে শকুনির পাশা শুধু জানে
 কত দানে কার স্মৃতি কতটা পোড়াবে 

নিয়ম পতিত  হয়।  অদ্বিতীয় একলব্যের কর্তিত 
বৃদ্ধাঙ্গুলি উৎসর্গ পেরোয় সামাজিক কসাইখানায়
 অযথা নিরীহ  বালকের শোণিত যাত্রায়
ভিজে যায় স্থল জল অন্তরীক্ষমূল
উদবাস্তু পথিকের ভিড় কমাতে আগুন গোগ্রাসে
গিলে নেয় খান্ডবের বন

শেষ অন্ত্যমিলে পাওয়া প্রারব্ধ হিসেব
ধ্বংসের আওয়াজ আনে, অর্জুনের  স্মৃতিবিদ্ধ তীরে
ভীষ্মের অমেয় প্রতিজ্ঞার ফাঁকে-ফাঁকে
 ভুয়ো দায়-দায়িত্বের প্রগাঢ় গান্ডীব হাতে নিয়ে
 শিখণ্ডী দাঁড়িয়ে আছে লিঙ্গহীন অপত্য জগতে


অলংকরণ - কনিষ্ক শাসমল 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••


Saturday, 12 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -১

শুভ্রাশ্রী‌ মাইতি'র কবিতা -


[] শুশ্রূষা

বুকের ভেতর গোপনে, খুব গোপনে
বয়ে যায় এক ছলাৎছল নদী

দুঃখ বাড়লে, তার পাশে এসে বসি
নির্জন বিকেলে ঘুঘু ডাকে, ডাকে
রূপসী বাংলার মাঠঘাটঝিঁঝিঁ
বর্ণমালার বিশুদ্ধ আবহ যেন

জলের ক্ষয় গোপনে নামিয়ে রাখি
সে আমাকে ঢেউ, স্রোত, নৌকা দেয় 
পালতোলা জাহাজ, গলে যাওয়া
খড়ের প্রতিমার ভেজা ভেজা আশিস

মনে মনে তাকেই আমি
বাংলা ভাষা বলে জানি


[] সেলাই

পড়ন্ত ছায়ার কাছে
অনিঃশেষ দাঁড়িয়ে থাকি

সে আমাদের দুঃখের গল্প শোনায় রাতদিন
আমাদের আলো আর অপ্রতুল আগুন,
আমাদের পাতাখসার বিষণ্ণ, করুণ কাহিনী

ভাবছি, সুখের গল্প শোনাতে বলব 
তাকে এবার; এক উষ্ণ সোয়েটারের 
আশ্চর্য বুনে ওঠা...সোজা, উল্টো,
উল্টো, সোজা...ঘর ফেলা, তোলাতুলি

দেখতে দেখতে শীতের পালক
ঝরে যাবে আমাদের; রোদ্দুরে
ভরে যাবে পরিযায়ী জন্মের পাতাগুলি


[] শবরী

যদি দাঁড়াতে হয়, 
এইখানে দাঁড়াবো খানিক...

এই মরা নদীর সোঁতা
রুপোর কাঁটা বাঁক শিয়রে
ধানগমের আলো; সাঁকোজীবন;
আবহমান... ভাঙাচোরা, নড়বড়ে

এইখানে, ঠিক এইখানে 
বহুজন্ম ধরে দাঁড়িয়ে থাকব আমি...
যদি নেমে আসো হড়পা বানে তুমি
ভাসিয়ে দাও সমস্ত অভিমান, নুড়িপাথরে


হাতের পাতায় এ ডুবন্ত আকাশ, 
বৃষ্টিরেখ জানালা, ঝিঁঝিগানের 
সরগম স্বাক্ষী; অপেক্ষায় আছি...
জোছনার মালাচন্দন নিয়ে
অন্তহীন অপেক্ষায় আছি


অলংকরণ - কনিষ্ক‌ শাসমল‌ 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••


Friday, 11 April 2025

কবিতা

আঁচলডোবা জল পর্ব -১

∆ দিশারী মুখোপাধ্যায় এর কবিতা -

[] বিপন্ন প্রেম 

তোমার সঙ্গে অনেক কথা ছিল , বলা হল না ,
কাছে যাবার রাস্তা পাচ্ছি না ;
টেলিফোনের টাওয়ারও সক্ষম নয় ।

কয়েকটা সুন্দর সুন্দর জামা বেছে রেখেছিলাম 
তোমার কাছে যাবার সময় পরব বলে ,
যাওয়া হল না ,
পরা হল না ।
রাস্তাগুলো মাঝে মাঝে কাচের পুতুলের মতো ভেঙে গেছে ।
ভাঙা রাস্তাগুলোর মাঝে মাঝে 
মৃত ও ধর্ষিত বিশ্বাসের শব পড়ে আছে ।

যে সব কথা বলা হল না , যেগুলোকে এতদিন 
সুন্দর ও পবিত্র মনে হতো ,
আমার নিজের সেই কথাগুলোকেই এখন ফাঁদ বলে মনে হচ্ছে ;
ধারালো ছুড়ির মতো তাদের রূপ।

ঘরে ফিরে আসি ।
হ্যাঙারে ঝুলন্ত সুন্দর জামাগুলোকে এখন 
প্রতারকের পাসপোর্ট বলে মনে হয়।


 [] বাগানের বাইরে থেকে 

ভেবো না, না-ডাকলেও ,গেট খুলে বাগানে ঢুকব ,
দরজায় কলিংবেল আছে বলেই তা বাজাব।

তোমার ঘরের করিডরের নৈঋতকোণে একটি পামগাছের পাশে 
বিষণ্ণ মনে বসে আছে ভায়োলিনটি ,
আমি গিয়ে যদি তাকে একটু স্পর্শ করি 
একটা হাল্কা সবুজ রঙের উষ্ণ আলো জ্বলে উঠবে তার চোখে ;
কিন্তু সংবিধান অমান্য করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
সে একদিন আমার কাছে পরামর্শ চাইবে , - এই বিশ্বাসকে 
রোপণ করে চলেছি অবিরাম।

ডাকোনি বলে ভেতরে ঢুকিনি ,
ঢুকিনি বলে চোখে দেখিনি , হাতে স্পর্শ করিনি ,
কণ্ঠে ধারণ করিনি ঈর্ষার কামড়।

গেটের বাইরে দাঁড়িয়েও আমি দেখতে পেয়েছি সবুজ গর্ভাশয় ,
দুহাতে মেখে তৈরি করেছি প্রতিমার মাটি ,
তোমার বিষদাঁতের ওষ্ঠে দিয়েছি চুম্বনের মধু।

ঠিক এই মুহূর্তেই একডজন শাড়ি উড়ে যাচ্ছে আকাশে ,
একটু পুরনো ভাষায় যাকে বলে বলাকা।



[] মধ্যপদলোপী 

এই মধ্যবর্তী সময়ে যে লেখাগুলো শরীরী ভাষা পেল না 
তারা এখন কোথায় রয়েছে খুঁজে পাব না।

যেসব নিরাকার যন্ত্রণা আমার দৈহিক যন্ত্রণাগুলোকে লঘু করছিল 
তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে গেছে একটি মেয়ে ।
তার অকুতোভয় শরীরের মধ্যে পারমাণবিক আকার পেয়েছে 
ওদের তীব্রতার মিনারগুলো।

আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতাগুলোকে আমি 
তার কাছেই যেতে বলেছি এখন ,
সে তাদের অভয় মন্ত্র দিয়ে আবার ফেরৎ দেবে আমাকে।

এই মধ্যবর্তী সময়টুকুর বিবরণ 
তোমরা ইতিহাসের মধ্যে রেখো না ,
পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ইতিহাস।


অলংকরণ- কনিষ্ক‌ শাসমল‌ 
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••