কবি সুভান এর কবিতা-
১।। ∆ এই_নিস্তব্ধতা_আমরা_কেউ_চাইনি_কোনোদিন ∆
শব্দের জন্য আর কোনো অপেক্ষা থাকবে না একদিন জেনেও, প্রেম হেঁটে আসবে পুরোনো করিডোর ধরে, বিচ্ছেদের রঙ পায়ে যেভাবে এসেছিল বসন্ত শেষবার... তেমন ভাবেই পাতাঝরাকালও এসেছিল... তখন তুমি একটা আলোর রেখার মত ছিলে, এখন ঝড় আঁছড়ে পড়ে দেহের ভেতর... অন্ধকার আঁছড়ে পড়ে আরেক অন্ধকারের ভেতর... কেন হত্যা হও আচমকা বাতাস, ভোরের পর ভোর পলাতক হও সময়, এভাবে কথা আসে নিয়মমাফিক, পুরোনো পুরোনো.. শ্যাওলা জমা সেসব আধঢাকা আশ্রয় খুলে যায়... রাতের রুমালে কে যেন নোনাজল রেখে যায় অপেক্ষার, এমন রাতের জন্য তার কাছে শরীর খুলে দেওয়া যায় সহজেই, রাত যদিও ভঙ্গুর, ক্ষীণ হয় আজকাল... কথার জন্য গাছ ফুরিয়ে আসে, কি দেখবে তখন? নিষিদ্ধ ফুল? তুমি বরং ফিরে যাও তীক্ষ্ণবিষাদ... চোখের রঙ ভয় পাও? দেখো, এখন ঘুমিয়ে পড়াটা কত সহজ মনে হয়, যত ঘুম আসে কবিতায় শব্দক্ষয় হয়, অবধারিত একটা নীলস্রোত নেমে আসে, তোমার ভ্রম পার হয়ে আসাটা তাহলে নিতান্তই সহজ... ক্ষতর ভেতর সূর্যাস্ত দেখা যায়। ছায়া দীর্ঘ হতে হতে ছিঁড়ে যায় দুই প্রান্তে, তাহলে প্রেমই আজও সবচেয়ে সহজ, সহজেই পাথরের গান শোনা যায়.. শূন্যতার দশক থেকে বের করে আনে কবিকে যে কিশোরী, তার বুকে হাত থাক আজ সারারাত... কিশোরী তো আসলে পুতুল, তার ঠোঁটে ফালাফালা নিয়মের সেলাই, তার হাত জুড়ে ঠান্ডা মাটি... গাছের শেকড়.. তার বুকে পাথর ঘষার দাগ দেখে মনে হয়, চোখের জলের ভাষাটাই তবে একমাত্র সহজ ভীষন... কিন্তু চোখ তো কথা বলে, অনর্গল কথা বলে, চোখে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় কই, কিশোরী কাছে আসে, বলে_ কাছে আসাটাও তো কতটা সহজ দেখো কবি... তুমি সহজ বোঝো না? হাতে হাত রাখা সহজ নয়? ঠোঁটে ঠোঁট? কথার সঙ্গম বোঝো কবি? সহজই তো? ভালো সন্ধে নেমে আসে শহরে, কিশোরী বলে_ "এবার তবে ফিরি... হাসি দিলাম, ঠোঁটে মেখে রেখো..." জল স্থির হয়ে আসে, ধ্বনি কাঁদে বহুদূর... এতই সহজ? এতই সহজ? ফিরে যাওয়া, এতই সহজ... আমি বলি ফিরে যাও তুমি সত্যি ফিরে যাও, সহজ যখন, ফিরে যাও, কথা ফুরিয়ে এসেছে, মেঘের দাবিও ফুরিয়ে এসেছে, এখন চুপ থাকি তবে, কবি বলে_ চুপ থাকা টাই সহজ ভীষন... তবু...
এই নিস্তব্ধতা আমরা কেউই চাইনি কোনোদিন।
২।। ∆ দূরত্ব_রাখুন ∆
নিজেকে শিল্পজগতের সুলতান ভেবে নেওয়া
বৃদ্ধ সরীসৃপদের থেকে দূরত্ব রাখুন।
দূরত্ব একটি সুলভ সংস্করণ।
কাছে যদি যেতেই হয় বৃদ্ধ মৃৎশিল্পীর কাছে যান।
সে আপনাকে মাটির প্রতিমা গড়ে দেবে।
ভালো শোনার অপেক্ষায় বাবুদের উঠোনে
কামিণীগাছ হয়ে থাকবেন না। গন্ধে সাপ আসে।
বরং কণ্ঠিবদল করে নিন অবুঝ নরম তুলসী কাঠে৷
মনে রাখতে হবে, জলে নামলে সবাই কুমির,
ডাঙায় বাঘ। অন্যের পাড়ায় ভেরো কুকুর।
আপনি সুযোগ বুঝে পাখি হয়ে উড়ে যান।
দানা ছড়ালে খাবেন না শুধু।
দানায় ছোবল ছাড়া কিছুই থাকে না।
সে আপনাকে প্রাণের বায়ু দেবে না।
তৃষ্ণার জল দেবে না। দু-মুঠো অন্ন দেবে না।
দূর থেকে দেখবে আর চুপ করে থাকবে
আপনার নতুন পালকের আগমন দেখে।
আপনি উড়ে যান আপ্রাণ। ওড়াই নিয়তি।
আপনি পাখি। গেঁয়ো যোগী নন।
হাততালির ভেতরে সরীসৃপ শুয়ে থাকে
মনে রাখবেন।
আপনার পরিচিত সরীসৃপদের চিনতে শিখুন।
দূরত্ব রাখুন।
দূরত্ব একটি সামাজিক বিধি।
নিষেধ।
৩।। ∆ পোকা ∆
ভেতরে ভেতরে কী যে খেয়ে নিচ্ছে আমায়,
যে ভাবে পাখি দানা খায়, উড়ে যায় শেষে...
পোকা হাঁটছে!
পোকা পড়ে যাচ্ছে।
পোকা উঠে দাঁড়াচ্ছে অথচ
ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
আমার সাদায় আমার সমস্ত পাপ
সমস্ত কাদায়, পাঁকে জলজ মাকড়।
হাসি আঁকছি ঠোঁট ছাড়াই,
ফুল আঁকছি পাপড়িহীন।
মাছির গায়ে বসছে বিষ
বিষ মাখানো কাঁটার মুকুট মাথায়,
এই রাজ্যপাট এই প্রজামন
সব তথ্য লোপাট হচ্ছে গোপনে।
বলব না তোমাকে কিছু বলব না।
কি করবে এসব শুনে...
আমার আকাশ ভালো লাগছে আজকাল।
ভেবেছি কটা দিন পাহাড়ের কাছে বসে থাকি।
বর্ষা এসেও কেমন থমকে গেল দেখো,
বৃষ্টি হলে তাও ভিজে নেওয়া যেত...
রঙপাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে নেশা করা পাপ
ভেবে যারা ফিরে গেল, তাদের জন্য আমেন
আমার একটা ঘর, রাত্রি তৃতীয় প্রহরে খেলে
রঙ আর অক্ষর এক জটিল মিশ্রণ...
রাত হলে আমাকেও চাঁদে পায়,
মধ্য রাতের রিক্সায় উঠে চেঁচিয়ে বলতে পারি
ঘুমাও সুজন। ঘুমিয়ে পড়ো। শব্দ না করে।
আমার ভেতরে একটা গৃহস্থ পোকার চলন,
খসে পড়ছে চুপটি করে বসে পড়ছে
সারাঘর ঘুরে বেরাচ্ছে,
আমি ঘুরছি আমার পিছু পিছু...
আমার সাদা পোকা, আমার কালোয়
আমার কালো কীট আমার বিষণ্ণতায়
আগুনের কাছে যেতে চাইছে....
৪।। ∆ কত_প্রেম_আমাদের_থেকে_গেছে_প্রিয়_ভাষার_আড়ালে ∆
ক.
কাঁটাতারে অক্ষর কেটে যায়,
অক্ষরে অক্ষতদেহ ঝুলে থাকে,
ভাষারক্ত বিষাদ, এসব মাটির দোষ,
সীমানারেখায় লেগে থাকা অসুখের গ্রাম,
নিষাদঅঞ্চল, হারায় হারায়...
কোথা থেকে দলে দলে এসে
মিশে যায় একলা বাতাস,
এই মেঘ নেমে এসেছে দীঘির জলে,
এই দীঘির ওপার জুড়ে
আমাদের না বলা দশক।
খ.
কত প্রেম থেকে গেছে আমাদের
পুরাতন গ্রামে,
ফেলে আসা ভাষার শহরে
বিবাদে দখলে ছেঁড়া কাগজে, কাপড়ে,
শিমুলগাছের ছায়াতলে,
ভাঙা কুয়ো আর পুকুর পারের
ঘোলাজলে,
স্নান হারানো বালিকার চুলে
দুপুর গড়ানো ছাদ,
কত প্রেম আমাদের
থেকে গেছে প্রিয় ভাষার আড়ালে...
গ.
শব্দের নিচে যে অন্ধকার লেগে থাকে,
সেখানেই ভাঙা ঘাতক চিহ্ন ভেদাভেদ
ছিঁড়ে রাখি।
এই পালিয়ে হারিয়ে যাওয়া
ফুরোনো একলা করুণ সন্ধ্যায়,
বাংলাসরণী ধরে বিষন্ন কবিতায় হাঁটি।
আমাদের নিঃস্বপ্রমাদ, ভাষায় আঘাত লাগে,
দেখাহীন চেয়ে আছি প্রেম
... দেশকাল ভাগ হয়ে যায় আমাদের,
আমরা আলাদা আলাদা ঘুমের ভেতর
নেমে আসি...
৫।। ∆ গৃহযুদ্ধের আগেই তুই পালিয়ে যা সুভাষ ∆
আমার আসল জানে
তোমার নকল সে হীরকচূর্ণ, বালিহাঁস।
কুমিরে হৃদয় খেলো
এখন পুকুরে ভাসে ত্রাস।
কচুরিপানায় মুখ ঢাকা কবিদের ভিড়ে
পানকৌড়ি ডুব হয়ে বেঁচে থাকা ভালো।
জলে রঙ মেশে, রঙে জল।
কোথাকার কথা কোথায় গড়ায় বল...
এই যে জলের চিড়িয়াখানা
মজায় লুটিয়ে হাসে প্রাচীন দেবতা,
রাজায় রাজায় যুদ্ধ লাগে; পেটে ভিজে
গামছা জড়িয়ে বরং ঘুমিয়ে পড়া ভালো।
গৃহযুদ্ধের আগেই দৌড়ে পালিয়ে যা সুভাষ।
এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে
রক্ত মৃদু ভেসে চলে রেসের ঘোড়ার নালে।
আস্তাবলে, লুকিয়ে ইশারাময় চাকা,
লঘু তার লোপাট দালান।
উড়ে যায় দেহনাগালের শেষে।
সাদা কবুতর। ছড়ানো গম খায়।
দিনের শেষে সকলেই ঈশ্বর হতে চায়।
সমাচার শেষে তবু তো হাত পাতে।
ভক্ত জানে না তার প্রভুও কাঙাল।
বৃষ্টি মাতিয়ে রাখা কালোজলে
ডুববে না আলো, বলো?
দেখি কে কাদা দেবে সাদা কাগজে?
সাঁতরে করেছি পার, দেহ যে মাতাল।
নেশার অঙ্গে চোখ,
পাহাড় জঙ্গল যেন জলাধার।
জংলী প্রবাহে আমি শুনতে চাইনি ভ্রম।
ভ্রমরের বিষ নাও হুকুমের তাস। এক্কা কার?
কার গোপন দেরাজে লুকিয়ে আছে
কেউ জানে না।
ফুলের আড়ালে তবু অ্যাসিড গোলাপ ভালো,
কবি? সে তো খুনের পূর্বে হাসে সর্বনাশ।
অলংকরণ - মেহবুব গায়েন
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
No comments:
Post a Comment