কবি সমর দেব এর কবিতা -
১।। ∆ উপনিষদ ∆
কুয়োর জলে মুখ দেখেছো তুমি অনন্ত পাতালভেদী ছায়া
সেইখানে উলম্ব ঝুলে থাকে মায়াচাঁদ মরীচিকা যেন ডাকে
বিষাদের গাঢ় আলিঙ্গন ছেয়ে থাকে রাত্রির সমস্ত প্রহর
সুখশয্যা ছেড়ে নেমে যাও তুমি কুয়াশার চাদর জড়িয়ে
নক্ষত্রেরা চলে গেছে দূরে চাঁদের চোখের জল জোছনা হয়ে ঝরে
কে তার মোছাবে চোখ আজ রাতে সকলেই চলে গেছে বনে
খোলা দরজায় দুদ্দাড় ঢুকে পড়ে অনাহুত প্রবল বাতাস
হাঁটু ভেঙে বসে থাকো তুমি অনাসক্ত চরাচরে একা
তখন শীতের দাঁত ছিঁড়ে খায় জ্যোৎস্নার পেলব শরীর
অসহায় ঝুলে থাকে চাঁদ একা একা কাঁদে চরাচর নীরব দর্শক
অনন্ত সময় ভাঙে ক্রমাগত ভেঙে যেতে থাকে
ধারালো সময় মাড়িয়ে হেঁটে যায় কারা রক্ত নিয়ে বুকে।
২।। ∆ বসন্ত জ্যোৎস্নায় ∆
ছায়া নেমে এসেছিল জলে, সেই জলের কিনারে দুইজন চুপিসারে
যেই কথা বলাবলি করে গোপন ইশারার মতো কতকাল যেন
অন্ধকার ডুবেছিল জলে উপরেরর স্তরে তাই কখনও দেখেনি কেউ ঢেউ
মধ্যরাতে চাঁদ উঠেছিল তার সমূহ কলার বিস্তার নিয়ে
পুকুরের পারে সেই জ্যোৎস্নার হুটোপাটি স্তব্ধ হয়ে দেখেছিলে
তুমি, নতুন অর্ত কোনও অনুভবে এসে ছুঁয়ে যায়নি হৃদয়
বহুদূরে কর্কশ ডেকেছিল মাংসলোভী হায়েনার দল
স্বপ্নে তারা চেটেছিল গরম রক্তের স্রোত অন্ধকার চোখে
শব্দ নিয়ে এক্কা দোক্কা খেলায় মেতেছিলে সঙ্গীদের সাথে
জলের উপরে ছায়া সরে গেলে আলোর উদ্ভাস নিয়ে এসেছিল বসন্তের হাওয়া।
৩।। ∆ মাংসাশী বাঁদরেরা ∆
আলোর আলিঙ্গন চেয়ে পাথরের বুকে বসেছিলে অনন্তকাল
যাত্রার দলের ঝকমকে পোশাকে ঢাকা শরীরে অভিনয়ে
মেতেছিল রাজা নির্ভুল উচ্চারণে অনুপম ডায়ালগ তার
দর্শকেরা বুঁদ হয়ে শোনে মুহূর্মুহূ হাততালি দেয়
রাজার বুকের তলে ফুলে ওঠে লবণাক্ত জল দারুণ জোয়ারে
সন্ধ্যে থেকে একটাও বিড়ি না পেয়ে নেশা চড়ে গেছে তার
চরম কঞ্জুষ ওই অধিকারী মশায়ের ’পরে যত রাগ আছে
সবটুকু ঝেড়ে দেয় হতভাগ্য মন্ত্রী আর উজিরের ঘাড়ে।
যাত্রার দলের এইসব গোপন কথা সবটুকু জানা আছে তার
তবুও পরম আলোর ডাক নিশির হাতছানি যেন, মোহময়
আদিম পাথরের বুকে বসে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত গুনে গেছ শুধু
একটু একটু করে হেঁটে চলে গেছ পুন্নাম নরকের দিকে
সেখানে মানুষ নেই প্রেতাত্মারা পরস্পর খেয়োখেয়ি করে
বোমা নিয়ে অদ্ভুত জাগলারি করে মাংসাশী কয়েকটা বাঁদর।
৪।। ∆ জলের গল্প ∆
সুস্বাদু ফল দেখে ধরে নিতে হবে গাছও আছে তার
ফল তো আকাশে ধরে না গাছেদেরও মাটি আছে জেনো
শরীরেই বাসা তার গভীর গোপনে তবুও তো দৃশ্যমান হয়
এই কথা ভুলে গিয়ে মেদমাংসমজ্জাময় শরীর ছেনেছো
আপেলের গল্পে সেই গূঢ় ভ্রান্তি রয়ে গেছে ঠিকই
তীব্র এই হীনম্মন্যতা থেকে ডুবে থাকো পাপে
অথচ শিশুর মুখে আলো জ্বলে হাজার বছর
বসন্তে গান গায় পাখি প্রকৃতিতে ফুটে ওঠে মরশুমী ফুল
অনামিকা অন্ধ হয়ে গেছে এসব পড়ে না তার চোখে
জরাগ্রস্ত নাকে আর অনুভব নেই সুগন্ধ ফুলের
কাক হয়ে গেছে তার কাছে বসন্তের সমস্ত কোকিল
একই গল্প শুনে শুনে পচে গেছে আমাদের কান
নতুন কাহিনি বলো একবার গেয়ে ওঠো ভোরের সংগীত
পতনের শব্দ আর শুনবো না কোনও দিনই তারচেয়ে
জোনাকির গল্প হোক, জলেদের কথা, বাতাসের শব্দ শুনি এসো।
৫।। ∆ নক্ষত্র খসেছিল বলে ∆
সেইদিন নক্ষত্র খসেছিল বলে প্রদীপ জ্বলেনি আর সারারাত
প্রহরের পর প্রহর জুড়ে আমি একা একা যুঝে গেছি খুব
সেই অন্ধকারে আরও যারা অসহায় লড়ে গেছে ভাগ্যের সাথে
তাদের কারও মুখ আমি দেখতে পাইনি তারাও দেখেনি আমাকে
রাত জুড়ে ধুন্ধুমার লড়াইয়ের পর আমাদের রক্তাক্ত লাশ
টেনে নেয় কুকুর শেয়াল আলো আর দেখিনি আমরা
নক্ষত্রেরা একে একে খসে পড়ে জীবনের আয়ু হলে শেষ
ক্রমাগত আলো বিকিরণে তারারাও বুড়ো হয় ঠিকই
তারপরই অশুভ বার্তাবাহী হয়ে ওঠে তারা বয়সের ভারে
জেনে যায় চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে সব ছেড়ে
তখনও কাঁদে না কেউ আলোকবৃত্তের নীচে আছে যারা
রচিত হয় না শ্লোক অথবা শোকলিপি এপিটাফ কোনও
তারারাও অন্ধকার ভালবাসে নাকি অন্ধকার ভালবেসে অবিরত ক্ষয়
বিকিরণ শেষ হলে চিরঘুমে শান্তি খুঁজে নেবে বলে জ্বলে।
অলংকরণ - মেহবুব গায়েন
°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°
খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteদারুন, দাদা।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। পড়ে বেশ তৃপ্ত হলাম।
ReplyDelete