Friday 21 August 2020

কবিতা

শাপলা পর্ব-১৪

কবি হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এর কবিতা-






১।।   ∆ শেষ ট্রেনের খবর ∆



আয়না দিয়ে আমার যে নদী বয়ে গেছে
তাকে আমিই তৈরি করেছি একটু একটু করে
শহরের সব মূর্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে
অনেকটা পথ একা হেঁটেছি
আমার জামা তো আর কারও গায়ে হবে না
সঙ্গে ডাকতে পারি নি একজনকেও
দু'একবার বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল মাত্র
কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন গলি হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল
রাস্তার গায়েই আমার যাত্রা বলে
গলি আমায় নিয়ে সুবিধে করতে পারে নি

আয়নায় ফুটে উঠেছিল গোটা শহরের মুখ
কিছুটা পিছনে গ্রামের ছবিও স্পষ্ট হয়েছিল
আমার লক্ষ্য ছিল একটামাত্র তালগাছে
বিশ্বাস ছিল তাল খেঁজুরেই সাজিয়ে দেব দিগন্ত

সব ঝড় এসে লেগেছিল তালগাছে
উদ্দাম হাওয়ার শত হাতের অভিমুখ বদলাতে পারে
এমন কোনো প্রতিহত গুণিতক আমার নামতায় নেই
মরুভূমির গান শিখে যে ছেলে আয়নায় তাকিয়েছিল
তারও পাও কিছু দূর গিয়ে বালিতে পুঁতে গিয়েছিল
আয়নায় এখন বালি, কাঁচ, সাপের মতো 
প্যাঁচানো অন্ধকার, হলুদ বাতাসার মতো চোখ

যে মুখের দু'ঠোট সারা দুপুর 
আপন বংশলতিকার গানে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল 
পকেটের জমানো টাকা উড়িয়েছিল হাত খুলে
তারা এখন গভীর রাতের স্টেশনের অন্ধকার কোণে 

শেষ ট্রেনের খবর এখনও কেউ জানে না।





২।।   ∆ চিরকালীন কুয়াশা ∆



শেষ ট্রেনে রাতের গভীরে যারা স্টেশনে নামলো
সকালের কুয়াশায় যারা আগেই স্টেশনে নেমেছে
আগামীকাল দুপুরে যারা স্টেশনে এসে নামবে
তাদের কারও মাথার ছাদ নেই
শুধু ঘর নেই বলেই তারা গলা খুললেই
তা দিগন্ত পেরিয়ে সমুদ্রে মিশে আন্তর্জাতিক হয়ে যায়

নক্ষত্রের গ্রাম থেকে যারা হেঁটে এসেছিল
তারাই একমাত্র জানে সূর্যের স্বাদ 
পৃথিবীর কোনো উপমায় তারা কান দেয় নি
নিজের গর্তকে ভালোবেসে ছিল খুব
আর নিজে হাতে গর্ত খোঁড়ার প্রক্রিয়ায়
শ্রদ্ধা ছিল বলেই খুব তাড়াতাড়ি তা পাঠ্যে এনে তুলেছিল 

স্কুল বাড়ির সমস্ত দরজা একমুখী
ঘর আর উঠোন জুড়ে থাকে
সাপের মতো মাটির গভীর সংস্পর্শে থাকা
শাসকের কিছু বাজার চলতি চটুল হাওয়া
একাকী বড় হয় যাবতীয় মাংসের শরীর
কুসুম রোদ্দুরের তুলির গভীর টানে 
ধরা দেয় না রামকিঙ্করের হাসি

নদীর খাতায় লেখা থাকে 
কিছু জটিল সমীকরণের সহজ সমাধান
হাত দিয়ে যারা জল খুঁটেছিল 
নদীর প্রাসাদে ঢুকে কেউ কোনো ঘর খুঁজে পায় নি
বটপাতায় মাটির ইতিহাস লেখকদের কেউ চেনে না
গাছের মাথায় রোদ ----- আর কয়েক মিনিটের অপেক্ষা
সন্ধ্যে নামার মতো নিঃশব্দে হেঁটে যাবে লেখকেরা
তারপরই হাতে হাতে নেমে আসবে চিরকালীন কুয়াশা ।



                         


৩।।  ∆ মাটিদের ঘর ∆




বেড়ার এপারে হেলান দিয়ে আছে যেসব বেড়াল
তাদের কারো সঙ্গেই আমার খুব একটা চেনা নেই
শুনেছি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের কোনো এক সন্ধেয়
গোপন গহ্বর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ভেজা ভেজা গায়ে
সূর্যের আলোয় গা শুকিয়ে নেওয়ার অভিসন্ধি ছিল কিনা
পাশের বাড়ির লোকেরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি
তবে পাঁচমাথায় চারটে সভা করেছিল
কোনো মঞ্চ ছিল না
কে যেন তাদের শিখিয়ে দিয়েছিল 
এটাই মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার সবচেয়ে যুতসই শর্ত
আসল মাথায় ঢাকা ছিল নিজেদের পায়ের ছাপ

বেড়ার এপাশে সব বেড়ালের চোখ ছিল স্থির
আসলে তারা প্রচার চেয়েছিল সবচেয়ে স্থির প্রাণীর 
যেকোনো সময় যেকোনো দিকেই তারা চলে যেতে পারে
তবুও স্থির দাঁড়িয়ে থাকা আরও কিছু পায়ের প্রত্যাশায়
এই পথেই হেঁটে যাক সভ্যতার সবকটি নদী

ধুলোপথে যারা গান করে রাতদিন
ঘন্টা মিনিট সন তারিখ কে কবে দেখেছে তারা 
ফাটা পায়ে ধুলোপথ শেষ হলে 
গোল হয়ে ঘিরে ধরে কালো-কটা বিড়ালের ঘর 
সব মাটি আমাদের -------- উল্লাস শেষ হলে 
ভেঙে যায় সবুজের চারপাশে সবকটি বেড়া
গুঞ্জন ওঠে আলপথ ধরে, খুলে যায় সব নদীপথ 
সিংহাসনের নিচে যারা চাপা পড়েছিল 
তারা সব লতা হয়ে উঠে আসে হাতলে দেওয়ালে
তারপর সবকটি চারাগাছ জেনে যায়
চারপাশে ঘিরে আছে মাটি মাটি মাটিদের ঘর ।





৪।।   ∆ নরকের দেশে ∆




অস্বস্তিকর স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে মেঘলা আকাশ
কিছুই পড়া যায় না
আবছা আবছা হয়ে সবকিছু
চোখের সামনে দিয়ে ঝুলে থাকে
উঠোনে এসে দাঁড়ালে হৃদয়ের মতো
প্রাচীন বট কাছে আসে
শেষবেলার একফালি রোদের মতো

দুপুরের রান্না হয়ে গেছে কোনকালে
ভাতের থালার রোদে স্পষ্ট হয়ে উঠছে 
একটা দুটো তিনটে চারটে পোকা
সাতসকালে ভীষণ ঝগড়ায় যাদের ঘুম ভেঙেছিল
এখন ভাতের গন্ধে তাদের শরীর থেকে মুছে যাচ্ছে
দখিনের হাওয়ায় শেষ ঘামবিন্দুর মতো খিদের কষ্ট

মিনিটের অপেক্ষাতেই মনে হয় সব পাথর হয়ে যাচ্ছে
নদীর জলের কাছে দাঁড়ায় না কেউ
উঠোনের জলে ভেসে ওঠে একটাই শুধু বাড়ি
এমন দিনকে কি করে কোলে নিই বলো
মন না থাকলে শরীর যে পাহাড় হয়ে যায়

রোদের ডানায় পাখিরা উড়ে এলে
নদীর জল পাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে যাবে গল্প
সেই গল্পের কুঁড়েঘরে বাতাস আসে অঞ্জলি হয়ে
মেঘগান জলের আল্পনায় কুঁড়ের ক্যানভাসে
এত আয়োজনেও নিঃস্ব হলে
কথাপাখি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে 
চলে যাবে নরকের দেশে ।






৫।।  ∆ স্টেশনের ক্যানভাসে ∆




প্রতিটা ট্রেন ছেড়ে গেলে
স্টেশনের ক্যানভাসে 
একটু একটু করে রঙ ধুয়ে যায়
কথা বলতে বলতে কথারা সরে আসে
অনেকটা শরীর গুটিয়ে এনে
একটা বিন্দুতে এসে জড়ো হয়

রুক্ষ কথাদের এখন শুয়ে পড়ার সময়
খালি হয়ে আসা অক্সিজেনের থলির সামান্য অংশ
বাকি অন্ধকারটুকুর জন্যে

স্টেশনের শাসকের হাতে এখন অন্য রঙের প্রাচুর্য
অল্প একটু রঙ গুললেই অনেকটা দাগ হয়ে যায়
আঙুল তোলার মতো নেই এখানে কেউ
মাথা নিচু বলে এখানে তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়

কোনো কোনো গলির মুখে বসে থাকে
সাদা চুলের মতো স্থির মুরগি
কোনোদিন চারপাশ ফরসা হয়ে এলে
শেষ ট্রেনে উঠে চারপাশ মুখর করে দেবে।




অলংকরণ - মেহবুব গায়েন

•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

3 comments: