Saturday 10 October 2020

কবিতা

মাটি খোসা পর্ব-২

কবি উত্তম দত্ত এর কবিতা-




১।।  ∆ সন্ন্যাসিনীকে ∆



আমি বিশ্বাস করতাম, কৃষ্ণসাগর থেকে উঠে এসে অন্যমনস্ক আত্মারা একদিন খুঁজে নেবে তোমার কবিতা। সমুদ্রের দেবতারা উচ্চকণ্ঠে পাঠ করবে তোমার নিটোল অক্ষরবৃত্ত। আশ্রম থেকে উঠে এসে তোমার মাথায় হাত রাখবেন মধ্যযুগের স্বপ্নের কবিরা। ঈর্ষায় পুড়ে যাওয়া মানুষের চোখের পাতায়   ঈশ্বর-প্রতিম এক কবি লিখে রাখবেন সোনালি সংলাপ। অলৌকিক আলোয় সহসা ভরে উঠবে তোমার সব-হারানো ধুলোর আঁচল।

আমি জানতাম, মোহনায় পৌঁছোবার আগে তোমাকে পেরিয়ে যেতে হবে অগণন পিশাচের কালো হাতছানি, অসূয়ার মায়াজাল, অক্ষমের গোপন প্রস্তাব। নৈরাশ্যের জরাগ্রস্ত মেঘ ও কুয়াশা তোমাকে বিষণ্ণ করবে ভোরবেলা। শুধু কবিতার জন্য এইসব মৃত্যুস্নান দুপায়ে মাড়িয়ে যাবে তুমি।

তোমার শৈশব দেখেছি আমি, টলোমলো পায়ে অক্ষরের হেঁটে যাওয়া, কাঁচা হাতে প্রতিমা বানানো। তথাপি মাথায় রেখেছি ছায়া, স্নেহময় হাতের আঙুল। নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, একদিন ভুবন পেরিয়ে যাবে তুমি। একদিন আমাকেও ভুলে যাবে, যেভাবে সন্ন্যাসিনী ভুলে যায় ফেলে আসা জরাজীর্ণ গার্হস্থ্য আশ্রমের কথা।





২।।  ∆ 'ছিদ্র না পাইলে শনি প্রবেশ করে না' ∆



ফিরিয়ে দিয়েছ, তাই
এবছর কোনও ফসল হলো না 
আমাদের নাবাল জমিতে। 
উড়ুক্কু সাপেরা এসে নষ্ট করে দিয়ে গেছে
রূপবতী হাঁসের খামার।

মাঝরাতে উঠে জেলেপাড়ার বিধবা বউটি 
ঘুমন্ত তোর্ষার জলে ছুঁড়ে দিয়ে এলো 
গামলা-ভরতি ফলিডল। তার রমণের কাল
ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে এই নদী।

উৎসব-বাড়িতে গিয়ে আচমকা বেডকভার তুলে
আমিও দেখেছি জরাগ্রস্ত তোশকের মরা অট্টহাসি ।
প্রেসক্লাবে সাংবাদিক ডেকে আমিও বলেছি :
বিশ্বসুন্দরীর দাঁতে কীভাবে লুকিয়ে থাকে ঘুণপোকা। 

ফিরিয়ে দিয়েছ বলে, এই মৃত মফসসলে 
কবিরা মদ খাচ্ছে দুবেলা।
প্রকাশ্য রাস্তায় দিন-দুপুরে হস্তমৈথুন করছে
পাথরে মাথা কুটছে লুনাটিক ভিখিরির মতো
আর ক্রমাগত ভুল ছন্দে পদ্য লিখে ছুঁড়ে দিচ্ছে
পরিত্যক্ত ফসলের মাঠে।




৩।। ∆ প্রেত ও পিশাচের উপাখ্যান ∆



দুচোখে পেরেক গেঁথে 
চলে গেছ বলে 
তুমিও ভেবেছ অন্ধ হয়ে গেছি আমি।
ভেঙে পড়া প্রাসাদের ছাদে
মৃত প্রহরীর বন্দুকের পাশে
আর কোনো প্রেত জেগে নেই।

মানুষ মেরেছ তুমি --- 
মানুষের রক্তে ভেজা হাতে পাখিরাও ভোরবেলা 
গম খেতে আসে না এখন।
সারাটা বছর একটিও বৃক্ষ রোপণ করোনি তুমি। 
মনে রাখবার মতো একটিও অক্ষর
লিখেছ কি মানুষের চোখের পাতায়?
সারাদিন শুধু মহুয়ার চার ফেলে বসে আছ ব্যক্তিগত দিঘির কিনারে।

যেভাবে প্রত্যেক শিশু অসতর্ক অন্ধকারে একদিন বাবা ও মায়ের অলৌকিক সঙ্গমদৃশ্য দেখে ফেলে সারাদিন অস্বস্তিতে মরে, সেইভাবে 
একটা বোবা কালা তাঁবুর ভিতরে একা একা 
ঘুরে মরছি আমি। 
যেন কিছুই দেখিনি, কিছুই শুনিনি।

কিন্তু যতই আড়াল করো, একদিন তোমাদের অনাচারী সঙ্গম-দৃশ্য দেখে ফেলবে 
কাঞ্চন-বিলের পাখিরা। 
এবং কিছুই না দেখার ভান করে তারা 
পদ্মপাতার উপরে মাছ রেখে উদাসীন ঠোঁটে সারাদিন ঠুকরে ঠুকরে খাবে। 
আর তুমিও সমস্ত দিন কেউ কিছু দেখছে না ভেবে
ছোটো ছোটো পিশাচের হাত ধরে 
অন্ধকারে জাহান্নামে যাবে।

এই পাখিজন্ম আর ভালো লাগছে না বিনোদিনী।
এই নষ্ট স্টেথোস্কোপের গল্প আর ভালো লাগছে না। এই মৃত জিরাফের ভাষা 
এই দিন আনি দিন খাই ---- ঘন্টার জীবন 
ভালো লাগছে না আর।

ছোটোবেলায় যে বাগদি ছেলেটি 
আমাদের গরু চরাত 
আর খড়িনদীর জলে 
উড়ন্ত পাখির ছায়া দেখে দুহাতে মৈথুন করত
তোমার নতুন বন্ধুটির মুখ অবিকল তার মতো।

এইসব শ্যাম্পু করা রাখাল-বালকদের 
সস্তা আন্ডারওয়্যারের গল্প শুনতে 
আমার আর ভালো লাগছে না।




অলংকরণ- অতীশ কুণ্ডু

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°



No comments:

Post a Comment