Sunday, 28 November 2021

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-৩

রবিউল ইসলাম এর কবিতা-



১.

∆মুকুল ∆

 

বহু বছর ধরে

কঞ্চির ওড়নায় লেগে আছে একঘেয়েমি সুতোর অভাব।

 

পাশের ভাঁজে মাপ বেড়েছে

কুমড়ো –রসুনের অন্তর্গতসুখ

দরজার গুঁড়ি তেজপাতা পিচ্ছিল আবরণযুক্ত পুষ্প।

 

ঢোলালেবুর মতো উজাড় ঠোঁট এবং পিঠ।

 

পাঁচিলের নক্ষত্রে প্লাবিত হয় কব্জা

ছায়াগুলো উপযুক্ত কাঠামো

পাখির জীবন ঘাসে পেয়ে।



২.

∆ সেমাই ∆

 


অবশ্য –মানুষ মজুদ রাখে চেয়ার।

 

গোধূলির শাকপাতা ভাঙা শরীর

সাইকেল খাটুনি খাটে মাচা পোক্ত করার জন্য।

 

বাড়ির বিছানায় সোজাসুজি ঘোড়ার শ্লোক

হাওয়ারখরগোশ নাচে শীতনদীতে

সুকোমল টমেটোউরু জড়ীভূত ঐ বারান্দায়।

 

হাতুড়িস্বার্থ নোঙর ফেলে মাছ পদধ্বনিতে

কম্বলের কুয়াশায় ভিজে যায়

মুগডালের চুল।



৩.

∆ তালা-চাবি ∆

 


নিজের জায়গা ছেড়ে গেলাম ভাত –মাড়ের কাছে

জেনে নিতে পরিচয়।

 

অথচ

সে আমার থেকে দুঃখী

লকলকে দুঃখ তার

হৃদয়ের কানায় কানায় ভরে ওঠে গৃহস্থালি কাস্তে।

 

দারুণ ঘুম ভাসা ক্লান্তি।

 

মাটির ঝিক

চেলাকাঠের টক দই

দম নেওয়া লাটিম

বৃষ্টির তোলায় জ্বালে আলো।

 


৪.

∆ দুপুরের নূপুর ∆

 

কোনো বন্ধনে –চিরো বসন্ত থাকে না।




৫.

∆ উৎসবের ফুলদানি ∆


 

রাতের কলসিবোতাম

শিমপীড়ন বেয়ে নেমে আসে।

 

অন্ধকার বালির চাকা শহরে ঢুকে যায়

অলিগলি এবং চতুর্দিকে শূন্যফুলের আড়ৎ

সমস্ত গন্ধ বাদুড়ের খেপলা দুচোখের মতো।

 

ভীষণ

পৃথিবী

বড়ই ছোটো এই বুকের তুলনায়।

 

জনপথ

দোকান

সুরের ধারা

ও পিচিয়ে রাখা ঝিনুক।






ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-৩

বিশ্বজিৎ বাউনা’র কবিতা-



১.

∆  পাললিক কান্না ∆



নিরুত্তর পাখি থেকে গড়িয়ে পড়ছে খুব খুনী উর্বরতা...
আমার অক্ষরে অক্ষরে মেঘ-ভাঙা প্রবল জ্বরের হানা।
তাকে কোনোদিন কাছে বলতে না-পারা সে সৌখিন মৌনতা
এখন ডিঙি ছলাৎ থিতিয়ে জমায় পাললিক কান্না।

স্নায়ুর সখ্যতা আঁকড়ে বুঝি, অভিমান খুব বেসামাল;
প্রয়োজনীয় উপুড় আর লেখা নেই আদুরে ইনবক্স জুড়ে।
স্খলিত পাতার মতো অতীত এভাবেই কি তবে চিরকাল
বিশুদ্ধ হয়! শাব্দিক চিৎকারে অপূর্ণতা যায় পুড়ে পুড়ে...

কিছু কি ক্ষতি হয় সে সোনালী শস্যের সুখ উঠে এলে ঠোঁটে,
দু হাত জুড়ে কি এক অবাধ্য সমর্পণ আজো খেলা করে--
প্রেম কি ফিরবে বাদশা শাহরুখের কাঁচ ভাঙা আখরোটে?
আজ শুধু ফালি ফালি ফাল্গুন গুমরায় যে যার আড়াল ঘরে।

অপ্রাপ্তি চরকায় খুব, স্থির বুকে সব সামলাই নিরবধি,
বুঝি, উপেক্ষা এক পতন আর অপেক্ষাও আজ নয় ঔষধি।




২.

∆ ঔষধি বিষ ∆



আমন্ত্রিত যন্ত্রণা এখন আমার শূন্যঘরে
পালক খোঁজে না আর। বিরোধী হাওয়া দিকে দিকে---

আপেক্ষিক ওম নিয়ে এতদিন উড়েছিল যে ফড়িং
তার সহযোগী ডানায় সূর্যাস্তের শোক

ভাঙা-ভাঙা জমাট নষ্ট রঙ দিয়ে লিখে
ঊর্দ্ধক্রমে হলুদ শিখার প্রলেপ পেরিয়ে এখন চোখের কার্নিসে
চুপ। 

অপূরণীয় ক্ষতির পাশে
নত শীত-পোড়ানো খড়-ছাই...

এখন দু'বেলা শিকার-শূন্যতা খাবি খায় আত্মজ্বরে।

এই যে নিপুণ দহন, এর পাশে
আর দরকার নেই আগুনের ঝটপট

তুমি ঔষধি-বিষ
আজ স্বীকার করি অকপট।



৩.

∆  তথাকথিত আলো ∆



তথাকথিত আলোর ভিতরে ঢুকে দেখেছি এই আমি
ক্রমশ সুস্পষ্ট হতে থাকা বিড়ালের ওৎ আঁচড়।
থাবা থাবা সুখের বিপরীতে ক্ষুরধার নাব্যতায় আগামী...
হারিয়ে ফেলছি বটবীজের মতো স্বপ্নের সাজঘর।

এত যে অবহেলা, এত কাটাকুটি শিখেছি দু'বেলা তাও।
তোমার বুঁদ জুড়ে উড়ছে একরোখা বিকল্প দাগ।
দুরন্ত বিনয় দিয়ে আমার কলম ভেঙে কি পাও?
ভাঙা-ভাঙা সংলাপ ছুঁয়ে তুমি পাওনি টের সে বীতরাগ।

ফেরাই উষ্ণতা, পালক ব্যবচ্ছেদে জেগে সস্নেহ ঘাম।
দেখি, রোদ চলকে পড়ে যায় উঠতি ঘাসের আঙিনায়।
অপমান সামলে তবু মজ্জায় গেঁথে নিই ক্ষত আরাম, 
একাকী দুপুরে সরীসৃপ সুখে কে প্রজাপতি ছড়ায়?

সেতু নড়বড়ে, তবে পারাপার জেনে গেছে তার স্থির বিশ্বাস;
সাঁতার শিখি আর দেখি, দূরে উড়ে উড়ে যায় আলোর হাঁস।



৪.

∆  সন্ন্যাসী-ভস্মে ∆



কোন উচ্চারণের কাছে ঝুঁকে এসে আজ আমি
মাছরাঙা হবো? পাথর-গিন্নি খেলবো না আর।

ডিনামাইট স্পর্শ অতিক্রম করে গেছি আমি
শূন্যতার দিকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিগন্তের ডগায়
খসে পড়ছি কাক শুনশান আদিম কোটরে।

সত্যি ছিল না ঠিক যতটা ভেবেছি হৃদয়
অবুঝ ঈর্ষার ভিতর হাত পেতে তবু তোমাকে
সুগন্ধি শিলালিপিসম আঁকড়াই পূজনীয় মুগ্ধতায়

এই দোষ দেবত্বহীন

এই নভেম্বর ক্রমশ উধাও শিশিরের বিছানায়
কাঙ্ক্ষিত রোদের চকমকি ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়।

তবু কি এক আরোগ্য অদ্ভুত ছায়ার তাড়নায়
নিমরাজি আগামী এখন ফাঁসসম ভবিতব্য ভঙ্গিতে
লাজুক মজ্জা ফাটিয়ে সজোরে পুঁতে দেয় তুমূল অক্ষমতা।

তোমাকে আঁকড়াতে পারি না আর দাউদাউ,
শুধু নিরামিষ জলের শরীরে প্রাক্তন সাঁতার খুঁটে খুঁটে
নিভে যাই সন্ন্যাসী-ভস্মে।



৫.

∆  প্রদাহ ∆


কিভাবে দু'হাতে ভরে রাখি এত ধ্বংস, লুণ্ঠন, ভোগ আর মিথ্যাচার,
মানুষের কাছে আজ আর কোনো সহজিয়া পাখি নেই ভোরের আল্পনায়।
চলে গেছে পতঙ্গজীবনের স্বরলিপি, বিশুদ্ধ ছোবলের সহজাত দিন...
এই যে এত পরিকল্পিত ওৎ, দাম্ভিক প্রয়োগের দিবারাত্রি ক্ষমাহীন,
শীতের সোহাগে চিরহরিৎ ম্রিয়মান, ক্ষত লুকানো একপেশে মলিনতা,
এর কাছে কি হবে রেখে অমৃতের স্বর? বিশুদ্ধ কবিতার আর্তি?
ভঙ্গিল মগ্নতায় মানুষের মনে আজ আর ওড়ে না পড়শী ফড়িং,
কচিকাঁচা ঘাসের শিখায় শিশির-তৈরী আয়নায় ভাসে না প্রিয় মুখ।
জেরবার যন্ত্রণায় মানুষের ভিতর এখন সংক্রামক লোভের আলাদিন,
লাভক্ষতির পান্ডুলিপিতে আর ছায়া-সুন্দর নয় মেঘ-চেরা স্বপ্নিল বক।
আমাদের ঘুমের ভিতর হৃদপিন্ডে আর গড়ায় না সেই কাঙ্ক্ষিত
প্রথম বর্ষার জল-ছোঁয়া ধানবীজের অঙ্কুরিত ফসলের প্রবাহ;
পরিবর্তে রাখা আছে বিজ্ঞানসুলভ বিষ, গতিঋণ, সৌখিন টোপ:
ভালোবাসার কাছে সব ভালোবাসা হেরে হয়ে আছে প্রদাহ।




অলংকরণ - এনা 
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-৩

সব্যসাচী মজুমদার এর কবিতা-






১.


∆ কুলুঙ্গি ∆



যে কুলুঙ্গির মোহ ছাড়িনি কোন‌ওদিন
এখনও রয়ে গেছে আবির ও পুরনো পেরেক গুচ্ছ তাতে
প্রত্যেকটা ছবির সঙ্গে জুড়ে থাকে এই কুলুঙ্গিরা

মনে আছে অইখানে চিঠি রেখে হারিয়েছিলেন ভরে পাওয়া লোক
কুলুঙ্গির মোহ ছাড়িনি কখনও

কুলুঙ্গির তলা থেকে
তাকিয়ে রয়েছে ঝিঁঝিঁ
                         আকাশে অনেক তারা
তখন‌ই মনে পড়ে প্রতিটা সহজে ছিল
                                দাম্পত্য ঈশারা...




২.

∆ সারাদিন ∆



সারাদিন‌ এসে কৃকলাশ ছুঁয়ে যায়
আমি ফিরি জলে জল ফেরে বর্ষায়
একা হয়ে যাওয়া বাড়িটার স্তনে মৃদু
হাত দিয়ে বোঝে ডিসটোপিয়ান ঋতু

ভাত মাখবার আলো মিশে যায় ধানে
একা হয়ে যাই দহলিজ সন্ধানে
ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি আর ত্রাসে
শিশু হাত ভাসে দেখি যোনি পথ ভাসে

পরোজে লেগেছে বিহ্বলতর স্তন
না খেয়ে মরার যতটুকু সঙ্গম---
রং হয়ে যায় ভ্রণলিপিটির মতো
এ জীবন বোঝে অবলোকিতের ক্ষত!



৩.


∆ জনম জনম ∆



জনম জনম জলে ছাই পড়ে আছে
আর বায়ুস্তরে ঘটে ইস্কাবন
তারপর থেকে এ শ্রাবণ বিবলিকে 
 কখন‌ও লিখিনি ইস্তেহার

কেন লিখিনি তা
ভেসে যাওয়া মাছের প্লাস্টিক আর জানে রহস্যের মিথ

আমার এই বরষা ধারনায়
             যুগে যুগে সামান্য‌ই ঘটেছে লিলিথ



৪.


∆ মাশরুম ∆



এই ভেপে ওঠা বাড়িঘর
এই বৃষ্টি মিথ ও নিষ্কম্প ভোর
                     কেবল সন্তান চায়

অনাদি অনন্ত পুত্র কন্যা চাইতে চাইতে
একজন বাঙালি কবি হয়ে যায়

যার ছিন্ন শিরে ঝিঁ ঝিঁ বসে আছে
ইতস্তত জোনাকি ভেসে যায়...



৫.

∆ অরণ্য ঢেউ ∆



আমাদের অরণ্য ঢেউ আমাদের চুম্বনেরা
রজঃ দোষ করেই থাকে।যতদূর সিজদা ঘেরা
দুজনেই হাঁটতে গেলে আঁচড়ায় চড়াই পাখি
লিঙ্গের‌ও অপার্থিবে তামসের মতন থাকি

তবে কী পাল্টাবে না আমাদের প্রামাণ্যসুখ!
আরে এই প্রপঞ্চময় আমরাই গুগলি শামুক।
হাঁসে খায়।দৈব জনেও।জলে যাই অসাবধানে।
ও মায়ের বাঙালভূমা,যোনিহীন শিশুর কানে
বলে দাও এই ছায়ানট আমাদের মৌল দাবি
আয়াতে মানুষ একা... কোরাসে পদ্মনাভি

আমাদের অনন্য তাপ আমাদের দেশ মুসাফির
আমাদের সায়ান্হকাল আমাদের জয় রঘুবীর
সব‌ই এক জীঘাংসাধ্বক সব‌ই এক মীরার ভজন
আমাদের রেশন কালে ধাঙড় এই আমরা ক'জন




ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

Tuesday, 16 November 2021

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-২

সুপম রায় এর কবিতা-




১।

∆ খাদ ∆



ছায়া বাঁধার আগেই নিভে আসে আলো।
পাহাড়ি মেঘের পারে 
রেলিং ধরে যে মেয়েটি খাদের দিকে
তাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়;
আমার সাথে সেই মেয়েটির আলাপ নেই।
ছোটবেলায় এক শনিবার স্কুলের দেওয়াল টপকে ছাদে উঠেছিলাম,
ছাদ থেকে দূরের পাহাড় দেখা যেত 
   যেন আমার কাঁধ সমান উচ্চতা তার।
সেইবার প্রথম শুনেছিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা ---
জেনেছিলাম, এমন উঁচু পাহাড়েও নাকি মানুষ চড়ে।
জানি না, সেই দিন এমনভাবে রেলিংয়ের ধারে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল কিনা।

একটা বাঁশির শব্দ আসছে কোত্থেকে...
আজ পাহাড় চড়তে চড়তে বুঝতে পারছি -
ছোটবেলা, পাহাড়, আমি আর সেই মেয়েটির মাঝে
একটা কালো বড় খাদ রয়েছে।




২।

∆ বদ্ধহীন ∆



সম্পূর্ণ দেহকে শেষ অধ্যায়ের কিনারায় পৌঁছে যেতে দেখেছি।
দু’হাতে আগুন-পদ্ম, 
দু’চোখে তুলসী, 
নাকে তুলো,
হৃদকম্প বন্ধ।
এমন এক ডাকের ভালোবাসায় কে আর অমন সাড়া দেবে!
মাটিতে ফুলবীজ পুঁতে দিলে
সেও একসময় বড় হয়ে গন্ধ ছড়ায়।
এ-তালার কোনও চাবি নেই কিংবা এ-চাবির কোনও তালা নেই।
দেখছি, হারিকেন জ্বালিয়ে সে মিশে যাচ্ছে মাঝ-আকাশে;
আর আমার বেরসিক স্বপ্নে 
কোনও রকম ক্ষতের দাগ থাকছে না। 
সীমাবদ্ধে কিছুই নেই
শুধু মোহ ছাড়া।



৩।

∆ যে তারা নিষিদ্ধ ∆



নিষিদ্ধপল্লীর সেই তারাটা আজ কয়েক মুহূর্তের জন্য এসেছিল আকাশে ---
মরে যাওয়ার একরাশ সম্ভাবনার কথা জানাল আমাকে।
আমি যতবারই জীবনের কথা বলি, বাঁচার কথা বলি -
সে তার একেকটা শিরা ছিঁড়ে ফেলে শরীরের। 
আর যখনই মৃত্যুর কথা বলি,
দেখি সে তৃপ্তি পায় খুব। 

তাকে আরও বেশি বেশি মৃত্যুর কথা বলে থামিয়ে দিলাম আজ।
বললামঃ থাক আর নয়, একটা শিরা অন্তত থাক।
শরীরের শেষ শিরাটা ছেঁড়ার আগে যদি কখনও তোমার বাঁচার ইচ্ছে জাগে!

তারাটা হঠাৎ নিভে গেল।




৪।

∆ সর্বনাম ∆



কেবলই সর্বনামের বিশেষ্য আর বিশেষণ খুঁজে চলেছি ...

মরীচিকার প্রান্তগুলো 
            কখনও কখনও তীব্র ধারালো মনে হয় ।
আমি নাগরিক আগন্তুক ধ্রুব-গ্রহের, 
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কলোনির গলিতে পথ হারিয়েছি ।

পিছন থেকে যারা যারা আমায় ডাকে
তারা আমার নাম জানে না ---
আমি সর্বনামের বিশেষ্য আর বিশেষণ খুঁজে চলেছি ।

ফিরে এলে
যদি পারো অস্বীকার করো আমায়,
আমি নতুন নামের হার মেনে নিতে শিখেছি ।





৫।

∆ আক্রান্তকারী ∆




কবিতা লিখতে লিখতেই শব্দাক্রান্ত হয়ে পড়ছে কবি।
তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠছে পাহাড়, নদী, তারা।
সে তাঁর অক্ষর থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বাক্যে 
ছড়িয়ে দিচ্ছে মোহ-ঘ্রাণ,
বিস্তৃত করছে ছায়া কবিতার মহাকাশে।

সেই কবিতা পড়তে পড়তেই 
পাঠক দেখে নিচ্ছে ভবিষ্যৎ-বর্তমান, প্রাকাতীত কাল;
এমন কি মোহ থেকেই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে 
                           কবি এবং কবিতার।
এখন আক্রান্ত হচ্ছে পাঠক নিজেও,
নতজানু হয়ে বসে পড়ছে কবির কবিতার সামনে ---
এবং তার চোখ আর মুখে 
                          তৃপ্তির তারা জ্বলজ্বল করছে।
মন ও স্বপ্নে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কবির মুখ।



অলংকরণ-  এনা

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-২

অনির্বাণ দাশ এর কবিতা-



১।

∆ রাত্রিকালীন ∆



এদিকে পুন্নিমে চাঁদ শরৎ আকাশে 
টেলিস্কোপ ছাড়াই চন্দ্রযানগুলি দেখতে পাচ্ছি 
আরও দূরে এলিয়েন হাসছে হা হা

এখনও পৃথিবী জুড়ে কেউ খেতে পায় কেউ পায় না
গ্লাসে গ্লাসে সাজানো মদ দুধ আর রমণীর মন 

রজনী যাপনের ঘোর কাটে অবশেষে 

রাত দুটো বেজে গেছে আর আমাদের মাতৃদেবী শয্যাগত
রকের ছেলেরা যারা মেয়ে দেখে টিজিঙে অভ্যস্ত
ওরা এসে নিয়ে গেল হাসপাতালে 
মন্ত্রী ধরে বেড পেতে হয় যে-দেশে 
পাড়ার বখাটে দিনে ভূত রাত্তিরে দেবতা

গ্লাসে ঢেলে নিচ্ছি জল চোখ লাল 
পুবাকাশও...




২।

∆ অলি ∆



বহুফুলে ঘুরে শেষে দিনান্তের ক্লান্তি ---
গানের কলিরা ফোটে ঠোঁটে।দুটি কালো
চোখে কতো ভাষা তান! বন্ধু হবে বলো,
শিখে নেবো দর্শনের অপঠিত ভ্রান্তি। 
কতোদিন হৃদিতলে পরাগ প্রভৃতি
আসেনি নিবিড় হয়ে।সকলই হারালো।
বিষাক্ত হুলের ঝাঁঝে বিদ্ধ করে তোলো
জানি ; তবু সখি দ্যাখো পরান-প্রতীতি।

মধু আর পৃথিবীতে নেই কোনোখানে, 
কুসুম ধূসর হলো ব্যপ্ত ধুলো ঝড়ে ;
গভীর অসুখে আছি শোনো গো বিজনে
স্নেহ প্রীতি নেই আছি একা একা ঘরে,
পক্ষ বিধুনন করো মদির আননে
মরণের প্রৈতি দেখি প্রেম রূপ ধরে ।। 




৩.

∆ মাস্টার মশাই ∆



কোথায় চলেছেন বেখেয়ালি মাস্টার মশাই 
হাতে ছড়ি নেই বাজারের ব্যাগ
দুঁদে মাস্টার ভীষণ শাসনে ডানপিটেরা হতো জড়
সামান্য ভাইরাসে মুখ ঢেকে 
কোথায় চলেছেন বেখেয়ালি মাস্টার মশাই ।
যাকে সেদিন কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন
কালচক্রে সে কখন ডাক্তার সেজে পেন্নাম শেষে 
হাসি একগাল 
যার সেদিন মাথায় রেখেছিলেন হাত
সে এসে যেন না বলে কখনও 
'কিছুই দেখেননি মাস্টার মশাই'।
বেঞ্চে ব্ল্যাকবোর্ডে করিডোরে জমে উঠেছে ধুলো 
আগাছায় ভরা মাঠ স্কুলের প্রাঙ্গণ
ঘণ্টার শব্দেরা মিলিয়ে মিশেছে মাটিতে 
কাকে বকবেন কাকে শেখাবেন অ আ
কাকে চেনাবেন মনীষীর ছবি দেয়ালে
নিজেই কখন ছবি হয়ে ফ্রেমে বন্দি।
পৃথিবী ঘুরছে অবিরাম তার গতিতে 
প্রকৃতি কখন বেছে নেবে নিজ প্রিয়জন
কারা বেঁচে যাবে কারা যাবে চির অস্তে 
এভাবেই তো মানুষ এসেছে দুনিয়ায় 
ডাইনোরা অবলুপ্ত 

কবে শেখাবেন কলকল হবে ক্লাসঘর
সুর করে কবে পড়বে বলাই কানাই
কোথায় চলেছেন বেখেয়ালি মাস্টার মশাই ।।




৪.

∆ শোধ ∆



বসন্তের রাকারাত্রি পলাশ শিমুল ফুলে
আরণ্যক আভরণে রবিগানে মুখরিত করে
সে লিবিডো জাগানিয়া 

ভোটরঙ্গ দুনম্বরী অথবা মঙ্গলযানের স্থিতি 
ঈশ্বর পৃথিবী আর রাস্তার খানাখন্দ আলেয়া
ক্লান্ত করে দীর্ঘকাল

আসলে যেটা রোদ্দুর তা-তো যাপনের দিন 
যা-তে চন্দ্রাহত হই তা প্রতিফলিত রৌদ্রালোক
দিনের সমস্ত শ্রম রাত্রি ঘুম দিয়ে শোধ নেয় 




৫।

∆ নৈরাশ্যলিপি ∆



পৃথিবী শেষ হবে গরম বাতাসে
পৃথিবী শেষ হবে ক্ষুদ্র অণুজীবে
পৃথিবী শেষ হবে মাশরুম মেঘে
পৃথিবী শেষ হবে সূর্য নিভে গেলে 

অন্য গ্রহ খুঁজে নেবো এলিয়েন মিতা

তার আগে হাত ধরো নিবিড় চুম্বন
লিখে লিখে ভরে তুলি কবিতার খাতা ।
স্রডিংগার সাহেবের বিড়াল  বাবাজি
গজানন ঠাকুরের পদতলে এসে 
ইঁদুরের মৃতদেহ উদরস্থ করে 
এদিকে 
আদম ইভের এঁটো আপেলের টুকরো 
খসে পড়ে 
বাগানের বেঞ্চে বসে নিউটন শেষে 
খুঁজে পান পীরিতির কনা 

এখানে মানুষ ছিল রাঁধা হতো ভাত
সকালে অ আ ক খ পড়া করে শিশু 
স্নান সেরে স্কুলে যেতো।
আলো নেই আলো নেই শুধু দীর্ঘ যাম।।



ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-২

হেমন্ত সরখেল এর কবিতা-




১।

∆ পর্যুদস্ত ∆

                    

দেহের ভেতর থেকে
একটা পচা দেহ বের করে দেখি
অঙ্গ বলতে রয়েছে 
শুধু জিভ |

তাড়াতাড়ি 
লুকিয়ে ফেলতে চেয়ে দেখি
ব্যাক-এর অপশন হাসছে
দূরে দাঁড়িয়ে | বুঝলাম-
গো-হারা হেরে গেছি আমি |

এবার এ আধগলা নরদেহ কোথায় রাখি ? 
                  



২।

∆ দৈববাণী কিংবা ∆

     
         
'সব হবে', এটুকু বলে
চুপ করে থেকে গেছে যারা, হয়তো বা
তারপর আর জন্মায়নি কথার গর্ভে কথা কিংবা অতিক্রান্ত সময়
পিঠে বেঁধে এনে দেবে
কবে, কখন, কোথায় 'হবে সব'-এর অতল
শুকনো পাতায় পা চেপে হাঁটে শুধু এটুকু প্রত্যয়ী নিক্কন, 
ছেড়ে যাওয়া কোনো উদাসী পবন,
জোলো কোনো শেষ প্রহরের প্রিয় আকাল |

কেন যে চয়ন তবে, ওহে দুরন্ত শিশু
আনমনে তুলে আনা কেন পাহাড়ের গা থেকে
উত্তুরে হিমেল না পাওয়া,
কেন ভেবে নিতে ভাঙে সীমারেখা, অবাধ্য চঞ্চল শিশু,
তুমি তো জানো না, যে আসে
তার আগে ভরাট স্থানের শূন্যতা কতো গভীর
কতো অপূর্ব নির্মম
কী কঠিন তার ফিরে যাওয়া!

'সব হবে', এই মাত্র বলে, আর কাজে মেতেছে যারা
যা হওয়াতে ভাঙি সমগ্র নিয়ম-আচার,
শমন নিশ্চুপ শিয়রে, জ্বরে আত্মচিন্তন
তাদেরই কেউ বলে নানা অছিলায়,দুষ্টু ক্রন্দন 
'হবে' বলেই তো এত কষ্ট, বিকার। 

চুরমার 
হয়ে যাবে তুলাদণ্ড, প্রতারণা।
আধো আধো বোল যদি দৈববাণী হয় 
পাবো সাহসী ত্বরণ
'সব হবে', 'হবে সব', এমনই অলিখিত বিশ্বাসে 
জেগে থাক মন।




৩।

∆ কায়াকল্প ∆

     
                         

দুটো খাতাই এক অভিমুখে
শুধু তোমারটা অঙ্কের
আমার শাদা।

কী ভীষণ হিসেবি তুমি!
আতপের ছবি রাখো এঁকে

আমার ফুটন্ত জলে মরে হেজে ব্যাকটেরিয়া
দ্বার ছেড়ে দেয়
অনাদ্যন্ত লোভের জীবনে
মধুপ
জন্মের আগেই স্বৈরিণী হয়

শ্রমিকের লেবেল সেঁটেছি গায়ে।
জেগে থাকার
একমাত্র উপায়
      



৪।

∆ যাত্রা ∆


                          

যত ছিল যা যেখানে সব
মোছা কী হয়েছে পরিপাটি?
নেই তো-
ক্ষীণাংশ বাকি?

তবে কেন ধোঁয়ার গন্ধ 
সুতোর শরীরে
দেখা দেয় অপগণ্ড
পরিত্যক্ত পান্ডুলিপি স্বপ্ন দমকে

সেজে উঠবে বলে আবার বেঁকে বসবে নাকি?

এবারে ক্ষমা যে বারণ
প্রতিজ্ঞা অগুনতি
বুক পকেটে রেখেছি
ভুলে গেলে নাম পাবো ভুলো মন।
  
                  

৫।

∆ প্রতিশ্রুতি ∆


                     

টিপে টিপে পা
উঠে আসি মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে
থমকে আছো তুমি, দুটো মুঠো ভরে প্রেম
যেন ছুঁয়ে যাব কাঁধ
তুমি কাঁপছো। কেন কাঁপছো তুমি?
এখানেই, এই শীতল পাথুরে শীলনে
থেমে গেছে ফাগ
রেখেছি বসন্তদাগ
মাঙ্গলিক সুতো
কিছুতেই বলোনি সেটা যেটা খুব অনায়াস হতো...

আজ কোনো প্রচ্ছায়া ছায়ার ভেতর থেকে
রেশমের মতো গোটানো দেহে 
অন্য গুলালের অভিমুখে পেতে দেওয়া
মাখন মাখন গাল
কপালের বাহানায়
আবীরে সিঁথি প্রান্ত লাল
সটান সরে আসা অন্য কোনো বুকের জ্বরে
অন্য কোনো গন্ধ, অন্য আত্ম-পরে
দুটো মুঠো ভরে আজ তীব্র হুতাস
একটু একটু করে শোষণে রয়েছে জঁরে- ফাগ নির্যাস
বহুদূরে অগোছালো নিকষিত হেম
এইখানে, এই শীতল পাথুরে শীলনে রাখা
আমাদের প্রাক-বর্তমান ফ্রেম...

কোথায় আছো? বাড়িতেই, নাকি জিজ্ঞাসায়
আনমনে পৌঁছেছো মন্দিরে 
দেখতে কি গ্যাছো আজ বাঁশি বাজছে কোন্ সুরে?
আমি তো খসা পাতায় রেখেছি উৎসুক নজর
অগুরু চন্দনে যদি
ভেসে আসে ভ্রামরী কোনো খবর!
যদি থমকে দাঁড়ানো ছায়ার ভেতর থেকে 
প্রচ্ছায়া ডোবা কোনো সিঁড়ি ভুল করে
আজ পাঠিয়ে থাকো
যদি আজও, আমাদের দেখা হতে পারে, প্রত্যাশা রাখো
দুটো মুঠো ভরে রাখা আবীরে রাঙাবো গাল
ভেবে তুমি হঠাৎ চমকে যাও
পেছনে তাকাও_

এটুকু আশায় শুধু কেটে যাক এবারের ফাগ
'কারো হাতে যেন রঙ মেখো না তুমি!' নিঃশর্ত না-বলা এই শর্তটুকু-
থেকে যাক।

তারপর তো আবারও এইখানেই
এই শীতল পাথুরে শীলন
দূরে দূরে মরে মরে না মরে বেঁচে থাকা রোজ
অযাচিত টুপ টুপ মুক্তোর মালা,
ব্যর্থ কোনো খোঁজ...


অলংকরণ- এনা

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

Monday, 1 November 2021

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-১

কনকজ্যোতি রায় এর কবিতা-





১.

 ∆ কম্পাস ∆



দিগভ্রান্ত নাবিকের হঠাত্‍ আবিষ্কার করা কম্পাসের মতো
 খুঁজে পেলাম একদিন তোমাকে।
সেদিন  বুঝিনি মরচে ধরা কম্পাসটি ছিল অচল ।
তাই পথ ভুলেছি বারবার ।
উচ্ছ্বল আশা দুচোখে নিয়ে পাড়ি দিয়েছি উদ্বেলিত পারাবার।
প্রাণচঞ্চলতার কল্পনায় নোঙর ফেলেছি যে দ্বীপের তীরে
বুঝিনি তা ছিল শুষ্ক নির্জীব। 
মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে চেয়ে গেয়েছি বসন্তের গান ।
বিশুদ্ধ বাতাসের কামনায় ছুটেছি যে ডাঙার পানে ,
 বুঝিনি তা ছিল ক্ষণস্থায়ী মরীচিকা।
অনেক ডুবজল সাঁতরে পাড়ে উঠে বিস্ময়ে দেখি, 
ভিজে বালুচরে  পড়ে আছে ভাঙা
কম্পাসটির এক তীক্ষ্ম  শলাকা। 



২.

∆ ফ্রেম ∆



মন জুড়ে তারাহীন আকাশ
  হৃদয়ে অলীক কল্পনার অনুরনন
চোখের পাতায় ভেসে যাওয়া টুকরো টুকরো মেঘ।

অনেকদিন বৃষ্টি হয় নি,
সিঞ্চনের আশায় পাতাগুলি হলুদ
শুষ্ক ধানের শিষে ফলে না মমতার ফসল,
ক্ষয়িষ্ণু শিকড় উৎপাটনের অপেক্ষায়,
ধুমকেতুর মতো হঠাৎ এসেই মিলিয়ে যায়
লাল নীল আর সবুজ স্বপ্নগুলো,
ভালবাসার মোড়কে নকল সোনা
বাজারদর তারই সবচেয়ে বেশী
অলিতে গলিতে হীরের টুকরোর ছড়াছড়ি।

প্রজাপতিটা আসেনি অনেকদিন
ওটা শুধুই রং ভুল করে
ধরতে পারলে  বাঁধিয়ে রাখতাম
সুদৃশ্য ফ্রেমে,
নিরাভরন নয়, মালা দিয়ে।



৩.

∆ প্রবহমান ∆


                 

  একদিন
         চরাচরের নিস্তব্ধতায় মুখোমুখি
      রুদ্ধগতি মহাকাল, বিপুলা বৈশাখী,
        বনানীর মর্মর, হৃদয়ে কলতান
     নীল স্বপ্ন চোখে,  ভ্রমরের আহবান।

অতঃপর
      ঢাকা পড়ল নক্ষত্র, ভেঙে গেল বাঁধ
       আবিস্কৃত হল বেঁচে থাকার আহ্লাদ,
     ছায়া যেন কায়া, জগৎ তখন মায়া
   বুকের মাঝে আগুন, দৃষ্টিতে আলেয়া,
   স্বত্তার ইতি,  সংযমের বলিদান
   দুমড়ানো  পাঁপড়ি, তছনছ বাগান।

অবশেষে
   থেমে গেল তুফান, ঝরে পড়ল পাতা
   ঝর্না তখন নদী,  বালুচরে শূন্যতা,
   বসন্ত ইতিহাস,  গ্রীষ্মের হাতছানি
   অলক্ষে বাজল প্রলয়ের পদদ্ধনি



৪.

∆ স্বপ্নবৃষ্টি ∆


ঘাসের মত  হলে পদানত হয়েই থাকতে হবে,

তার চেয়ে কাঁটাঝোপ হওয়া ভাল 

অন্তত প্রতিবাদের অক্ষমতার আফসোস থাকে না।


মাটির মত হলে জড়বৎ হয়েই থাকতে হবে, 

তার চেয়ে নুড়িপাথর হওয়া ভাল

অন্তত পথিকের পায়ের সাথে কম্পিত হওয়া যায়।


ঢেউ এর মত হলে তীরে এসে ভেঙে পড়তেই হবে,

তার চেয়ে হিমশৈল হওয়া ভাল

অন্তত ক্ষণস্থায়ী  অস্তিত্বের দুঃখ থাকে না।


নক্ষত্রের মত হলে অবিরাম জ্বলতেই হবে,

তার চেয়ে চাঁদ হওয়া ভাল

অন্তত রাতের অন্ধকারে স্নিগ্ধ আলো বিতরণের গর্ব থাকে।


রাত্রির মত হলে সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই মিলিয়ে যেতে হবে,

তার চেয়ে  প্রত্যুষ হওয়া ভাল

অন্তত অল্প আলোর আভাসের মধ্যে উজ্জ্বলতার প্রকাশ থাকে।


মেঘের মত হলে পরনিয়ন্ত্রিত হয়েই উড়ে যেতে হবে,

তার চেয়ে আকাশ হওয়া ভাল

অন্তত অসীম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করা যায়।


বাতাসের মত হলে বয়ে যেতেই হবে,

তার চেয়ে দখিণাবায়ু হওয়া ভাল

অন্তত শুষ্ক হৃদয়ে আনা যায় শীতলতার স্পর্শ। 




ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-১


ফুয়াদ হাসানের কবিতা 






∆ কবরনামা ∆



  –ঐ ছোট্ট কবরটি
আমার কনিষ্ঠ ভাইয়ের
  –ওহ, কী কিউট


কবরে একটা
কোলবালিশও
রেখো–মনে করে,
তাকে ছাড়া ঘুম
আসে না আমার!


অনন্তদূর থেকে চোখে পড়ে কবরের চর
         কে সে এতোবার ওঠানামা করে
          তয়খানা আর কখনো ও-ঘরে
উইঢিবি তার উপরে বানায় নতুন কবর



মাটির গভীরে আরেক আকাশ অনেক তারার মেলা
মাটির ভেতরে অনেক আকাশ নক্ষত্রের ভেলা
ভেলায় নাচছে মেঘনা-যমুনা অমূর্ত যত ঢেউ
নাচতে-ভাসতে পাতাল নগরে পথভোলা বল কেউ
কেউ মেঘদূত শ্বেতমেঘ চিরে ওড়া নীলরঙা চিল
আমি কি অচেনা জোনাকির ভিড়ে আজ ফড়িং ফসিল
মাটির গহীনে অনেক আকাশ একটি তারার শব
মাটির শরীরে কান পেতে শোন অস্ফুট কলোরব



সবকিছু ভেঙে নিয়ে গেল নদী
বাজার-মাজার, সব বাড়ি-ঘর
সেও যদি হতো–আমার কবর


মাটির ভেতরে তবে কি অন্য এক পৃথিবী;
সহজে সাঁতার কাটা যায়, স্নান শেষে ঘরে
ফেরার বদলে চলে যাই দূর নীলিমায়
হাজার জনম ধরে যে আমার হতে চায়
অন্ধকারেও অনন্য রঙ লুকোচুরি করে
মরমী আঘাতে ভেঙে পড়ে শেষ ব্যথার ঢিবি

পোকামাকড়ের প্যাকে ডুবন্ত ফুলেল সড়কে
নাকি বেঁচে? ঘুমে? যেন বেহেশত–নব্য নরকে




অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


কবিতা

পাকা পাতায় শিষ আলো-১


আশরাফুল মন্ডল এর কবিতা-



১.

∆ বাঁশির সুর আর চাঁদ চাঁদ গন্ধ ∆



আমাকে ডাকছে অশ্রুতপূর্ব বাঁশি
চালাঘর ভাসিয়ে দিচ্ছে চাঁদ চাঁদ গন্ধ
পোড়ামাটি আগলে আমার নির্বাসন
সীমান্তবাসী একটি নক্ষত্রে রেখেছি চোখ
আমার মতোই অসহায় তার তাকিয়ে থাকা

কেঁপে কেঁপে উঠছে রাই জাগানো বাঁশির সুর
কোন এক অদৃশ্য অভিসারে আমার সত্ত্বা
ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার পরিচিতির সীমারেখা
সুরের মূর্ছনায় আমার অধিবাস 
বিশাল ছায়ার ডানায় আমার শ্রুতিপথ
কার যেন পাঁজাকোলায় আমার অস্তিত্ব

সুর তরঙ্গে ভিজে যাচ্ছে জবুথবু শরীর
বহুযুগের ওপারে বৃষ্টিভেজা কদমতলা
আরবি ঘোড়ার মতো ছুটছে চালাঘর
চাঁদের গন্ধে খুঁজছি নাড়ি নক্ষত্র
আমাকে টেনে ধরতে চাইছে পুরনো কিছু অভ্যাস
আমি এখন তেমন নই 

আমি এখন অন্য মানুষ
ভবিতব্য আমার ঠিকানা
মড়ার খুলির মতো আছাড় নেই
বাসি চুলোর পাশে ঝিমুনি নেই
নামতা মাফিক দিন গুজরান নেই
রোগ শোক রেখে এসেছি ছেঁচতলায় 
ঢেঁকিশালায় ঘুমিয়ে পড়েছে খুদের গন্ধ

সর্বাঙ্গে আমার বাঁশির সুর
নিরাকার বন্দরে পৌঁছে গেছি
কুয়াশা বিছানো শূন্যতা আমার চালাঘর





২.

∆ কোথায় যাব ∆



কোথায় যেন যাবার কথা ছিল!
ঘুরপাকে চক্কর দিচ্ছে যাবার বেলা-
তাড়াহুড়োয় হারিয়ে গেছে সাকিন ঠিকানা।
কোথায় যেন.....

কারা যেন বলেছিল যেতে পারো!
কোথায় যাওয়া জানি না তো!
পথের বাঁকে আর এক পথ-
হদিস নেই তোমারও।
কারা যেন.....

কে যেন মিহি সুরে বলেছিল হবে দেখা!
দেখা কি হয়েছিল?
হয়তো অনেক দেখার ভীড় একাকার।
তেমন দেখা কি হয়েছিল?
কার সাথে?
কে যেন.....




৩.

∆ সব সরলতা তোমার জন্যে ∆


সব সরলতা তোমার জন্যে
পায়ে পায়ে চলা সেও
শুধু গিঁট বেঁধে বেঁধে আটকে আছে আমার মরণ
ছটফটানি আমার তীর খোঁজা ভাঙা ডানায়

অনির্বাণ বাঁচতে চাওয়া তোমার জন্যে
খিদে জাগা চোখ সেও
শুধু শিকল পরা সুখে লটকে আছে আমার বাঁচন 
মুহূর্তের অনুভবে কুড়িয়ে নিই তোমার সরলতা




৪.

∆ ঠিকানা ∆

আকন্ঠ পিপাসা নিয়ে মানচিত্রে রাখি চোখ
দিন রাত শুধু বাদুড়ের মতো পাখা ছড়াই
খরচের তালিকা আমাদেরও ঠাঁই
আজ না হয় কাল

আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ ছিল না
নেই আজও
জবাই হওয়ার আগে এসো কথার অবগাহন
কৃতঋণ শব্দেরা তৎসম পঙক্তিতে বেমানান
তাই চালচুলো খুদকুঁড়ো ঘাড়ে দৌড়ানো
যাবো কোথায় অস্পষ্ট অলিগলি
কুলকুচি মাখা সান্ত্বনা হননের প্রতিভাস 
আমাদের হাসি নেই কান্না নেই কেবল স্তব্ধতা

এসো অনায়াস লুকোচুরি
এদেশ বিদেশ
ছুরির ফলায় স্বপ্ন সাজাই
বারুদের গন্ধে বাঁধা নির্লিপ্ত ভবিষ্যৎ
রাজার চিঠি পৌঁছে যায় বেনামী বন্দর
চিল শকুনের উচ্চারণে বাতাসের গান

হাপুস চোখে ঝাপসা মানচিত্র পট
ভেসে গেছে আমাদের ঠিকানা দস্তাবেজ




৫.

∆ ঘর ∆


ঘর কি ছিল কোনোদিন
আছে কি আজও

নেই শিশু নারী কলরব হাসাহাসি
ফুসুরফাসুর 
কানপাতা দেয়াল
হাটখোলা আদর

একটি ভিটেয় শুধু
মিটিমিটি
পিদিম জ্বলে সারারাত


অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০





Wednesday, 5 May 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


রঙ্গন রায় এর কবিতা-






∆ জানুয়ারি মাসের কবিতা ∆



প্রিয় কবির কবিতা পড়ছি
প্রথম দিক কার কবিতা 
তাঁর মেয়ের সাথে আমার 
এক অলৌকিক বন্ধুত্ব আছে 
কবিতায় ওর ছোটবেলা দেখা যাচ্ছে 
কবিতায় আমাদের অলৌকিক বন্ধুত্বের ছোটবেলা দেখা যাচ্ছে 



যেসব কবিতা গুলোয় তুমি আছো 
সেসব কবিতা তোমার বাবা পড়ে; 
বলে , এত সুন্দর কবিতা তুমি লেখো কী করে!

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে যায় 



করলা নদীর ধারে
সদর বালিকা বিদ্যালয় -
এই স্কুলে তুমি কোনোদিন পড়োনি 
তবুও সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে এখানে এলে 
তোমাকে তীব্র রূপসী মনে হয় 



যোগমায়া কালিবাড়ির চাতালে চশমা খুলে রাখো 
উত্তল লেন্সে মন্দির বড় হয়ে ওঠে 
বড় হওয়া লক্ষ্য করে তাকাই তোমার দিকে 
শ্বেতপাথরের মেঝেয় গোলাপী আঁচল 
ঈশ্বর ধন্য হয়ে ওঠে 



এই কবিতা গুলোর ভেতর তোমাকে রেখে দিলাম 
পৃথিবী জুড়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়বে




অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০



কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


কুশল ভৌমিক এর কবিতা-






১. 

∆ বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে ∆



বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপের গাম্ভীর্য নিয়ে
গুহায় ঘুমিয়ে পড়া অলস সময়
তবু স্থির কোন চিত্রকল্প এঁকে
কড়া নাড়ে বহুদিন না খোলা কাঠের কপাটে
ঝিঁঝিঁর ডাক,উত্তাপহীন জোনাকির আলো
আছড়ে পড়ে শ্যাওলা জমা প্রাচীন সিঁড়িতে।

মেহগনি পাতার ফাঁকে কেঁপে ওঠে চাঁদ
বৃষ্টিফোঁটার মতো জোছনার ছাই
টুপটাপ ঝরে পড়ে
পৌরাণিক পুকুরের জলে-
খলবল হেসে ওঠে খলিসা পুঁটি
দানকিনার ঝাঁক
বিষণ্ণ কানিবক পাহারা দেয় মায়ের শ্মশান
বাঁশঝারে কেঁদে ওঠে কানাকুহা
টিনের চালে আছড়ে পড়ে হুতুমপেঁচার দল।

টিনচালা দুটো ঘর হাত ধরে সারারাত হাঁটে
গল্প করে,অযাচিত আড়ালে ঠোঁটে আঁকে
মৌণচুম্বন।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো
বাড়িটি মেশে না কারো সাথে
ভেসে থাকে দিন রাত
ইতিহাসের ঘোলাটে ডোবায়

আমাদের বাড়িটায় মানুষের পদচিহ্ন নেই
উঠোনজুড়ে ঈশ্বর হাঁটে।




২.

∆ বেদনার হায়ারোগ্লিফিক্স ∆



এই যে আমি তোমার অবাধ্য ঠোঁটে
লেপ্টে দিলাম একটা কষ্টার্জিত দুপুর
আস্ত একটা কবিতার বই
বেদনার হায়ারোগ্লিফিক্স

এসবই আমার ক্ষুধার্ত প্রেমের নামতা।

যদি খুলতে পারো সমীকরণ
জীবনের ভগ্নাংশের ভাঁজ
দেখবে-

আকাশে ঝুলে আছে আইনস্টাইন
পাতার ভেতর খসে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ
আর পৃষ্ঠাজুড়ে লালনের একতারা
আর আমি-
ব্রহ্মান্ডের মতো তোমার খোলা পিঠে
দুলে ওঠা বেণির শিল্পকলা দেখে দেখে
প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভেতর ঢুকিয়ে দিই বিস্ময়

জীবন বস্তুত বিরাম চিহ্নের মাস্তানি!



৩.

∆ প্রত্যয় ∆



সূর্যটাকে দখল করেছে মালটি-কালার সময়
অন্ধকারের আচ্ছাদনে মরে গেছে রোদের প্রতিভা দ্বিধার দুপুরে
মায়ের উনুনে ভাত ফোটার গন্ধ
এটুকুই কেবল শান্তি আমাদের।

কবিতার বীজ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে
মাফিয়ারা
যেখানে পুঁতবে সেখানেই জন্ম নেবে কবিতাবৃক্ষ!
মাফিয়া এবং কবিতা
দু'য়ে মিলে অদ্ভুত স্থাপত্যকলা
এরিস্টটল প্লেটো বলে দিন;বলে দিন-
পোয়েট্রি এবং পলিটিক্স সমার্থক শব্দ কি না?

হোঁচট খেলে মানুষ সতর্ক হয়
সৎ ও সতর্কতা বিপরীত শব্দ জেনে
উপভোগ করি উঠে দাঁড়াবার আনন্দ।

হোঁচট খেয়ে যে হাসতে জানে

পরাজয় তার  সিলেবাসে থাকে না কোনোদিন।




৪.

∆ জীবনানন্দ ∆



যতবার মানুষ হতে চেয়েছি
কীভাবে কীভাবে যেন ততবার
হয়ে গেছি দুর্বোধ্য পান্ডুলিপি
শরীর বিদীর্ণ করা কালো অক্ষর
তাই আশ্রয় পায়নি
প্রেমিকার ফর্সা আঙ্গুলে।

সবিতা,সুরঞ্জনা, সুচেতনা
সচেতনভাবেই
উপেক্ষার চাদর বিছিয়ে
মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।
মলাটবন্দি হবার আকাঙ্ক্ষাগুলো
দুঃখে অপমানে লজ্জায়
বন্দি হয়েছে মরচে পড়া লোহার বাক্সে
উঁকি দেবার ঝুঁকিটুকু নেয়নি।
শ্রীহীন জীবনে লাবণ্য থেকেছে অধরা
কাছে থেকেও দূরের আক্ষেপে
আমি কতবার মরে গেছি।

নিঃসঙ্গ চিলের মতো
কেঁদে কেঁদে উড়ে গেছি এ ঘাট থেকে ও ঘাটে
ফেরি করেছি  বিপন্ন বিস্ময়
মন্দাক্রান্ত বিষণ্ণতা অথবা দুঃখ
এসবই আমার নাম হতে পারতো
অথচ আমার নাম জীবনানন্দ!

কয়েকটা কবিতার বিনিময়ে
তোমরা কেউ নেবে এমন একটা জীবন?



৫.

∆ নেই ∆



মায়ের গর্ভের চেয়ে বড় কোনো দেশ
ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো মাতৃভাষা
ক্ষুধার চেয়ে বড় কোনো সার্বজনীনতা
চোখ থেকে চোখ সরে যাবার চেয়ে বড় কোনো দূরত্ব
নিজের চেয়ে বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী
তোমার খোপার চেয়ে বড় কোনো ফুলদানি

নেই।নেই।নেই।






ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


মাহফুজ মুজাহিদ এর কবিতা-





১.

∆ হৃদয়  জংশন ∆

 


কিছু দুঃখ দাঁড়ানো আছে জংশনে

সিগনাল পেলে দৌঁড়ে যাবে

ভুল গন্তব্য ফিরিয়ে দেবে আবার

ছেড়ে যাওয়া জংশনের কাছে

কখনোই ভালো সিগনালম্যান ছিলাম না

কোনোদিন লাইনম্যান হয়ে পৌঁছে যাবো

ভুল করে জংশনে দাঁড়ানো দুঃখের সাথে

তোমার দরোজা খোলা রবে ট্রেনের দুপাশে

যেমন থাকে আগমন ও প্রস্থানের আঁড়াল

তবুও আমি প্রকাশ্যে বাড়াবো হাত

একান্ত কিছু দুঃখ লুকোবার

জংশনে জংশনে অনেক দুঃখ কুড়িয়েছি

স্টেশনে নামাবো বলে; তুমিহীন এ পৃথিবীর

কোথায় আছে সেই সে স্টেশন?


 

২.

∆ রক্তছায়ার হাত ∆

 

হাত

পানিরূপ লালে ভিজতে ভিজতে কবেই

মেঘগুলো সাদা থেকে লাল থেকে কালো

হতে হতে একদিন সবুজের দিকে চেয়ে

নিঃসঙ্গ ডাহুকের মতোন ডেকে ওঠে

প রি ত্রা ণ...

স্বপ্ন জেগে ওঠে

রাতের ঘুম থেকে বুকের ওম-খাঁচায়

ধনুক ছিলায় বাণ গেঁথে গেঁথে একদিন

শত্রুর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছি এই হাতে

পরম আদরে মাটির প্রলেপের মতোন

নিজের বুক জ্বলে গেলে কেউ শতবুকে

জ্বালাতে পারে দহনের সুখ গোপন অসুখে

উ ত্থা ন...

পতনের শব্দ

চমকে ওঠে বৃক্ষের খোলস

তক্ষক ডেকে যায় উত্তাপ দুপুরে একা

রক্তের লালসা ঝরে; দিগন্তজুড়ে ভয়ে

ডালে ডালে শকুন চেয়ে থাকে ডানামেলা

অন্ধ সময়ের ঢের আগে; অহেতুক শান্তনা

ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে রক্ত-মাংসের ঘ্রাণে

হা হা কা র...

পেট পুড়লে

মন ও মগজে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদ

থু মেরে দুরে ফেলি মিথ্যের বৈভবে আঁকা

আঁকা-বাঁকা মানচিত্রের জ্বলজ্বলে সাদাভাত

প্র তি বা দ...


 


৩.

∆ হঠাৎ নিশ্চুপে ∆

 


তুমি ছিলে?

তুমি কোথায় ছিলে?

তুমি কখন ছিলে?

কেনো ছিলে?

পৃথিবীর পথে, ঘাসের সবুজে,

রক্তবর্ণ ঠোঁটে, নীল জমিনে সাদার ভেতর

সকালের কোমল রোদে, বৃষ্টির ভেজা দুপুরে

শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় কিংবা

কিশোরীর চুলখোলা কোনো স্নিগ্ধ বাতাসে

বসন্ত দুপুর, শ্রাবণ বিকাল, শীতের ভোর

রাতের অন্ধকার, সুবিশাল উদ্যান

কয়েকশত বছর খুঁজেছি তোমায়

তুমি ছিলে?

তুমি কোথায় ছিলে?

তুমি কখন ছিলে?

কেনো ছিলে?

তুমি কেমন ছিলে?

একবার; তোমাকে একবার দেখবো বলে

ফিরিয়ে দিয়েছি চাঁদমাখা আদরের ঘুম

শুধু তোমাকে দেখবো বলে

শৈশব লাটিমে ঘুরেছি দুপুর-বিকাল, সন্ধ্যা-সকাল

একবার; তোমাতে হারাবো বলে

বিশ কোটি ভালোবাসা ফেলে ফিরে আসি বারবার

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই এসেছিলে পৃথিবীতে 

একদিন

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই ভালোবেসে অন্ধকারের 

দিন

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই দিনের কোলাহল ফুরালে আবার

দাঁড়াবে এসে শিয়রের উত্তাপে একদিন


 

 

৪.

∆ অনন্ত বিদায়ের মিছিলে ∆

 


লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

মানুষ হেঁটে যায়-- বিদায় বিদায়

কালেমায়, হরিবোল, ঈশ্বরের নামে

লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

অগণিত ক্লান্ত দিনের কথা হেরে যায়

হেঁটে যেতে যেতে মানুষের পা

তবুও ফুরোয়না পথ; দিগন্ত উদার

রোদ-বৃষ্টি-শীতে মানুষ হেঁটে যায়

মানুষ হেঁটে যায় কবরে-শ্মশানে

হেঁটে যেতে যেতে বিদায় জানায়

অন্তিম দিনের ব্যথা ভুলে ফিরে আসে

শোকের উদোম তৃষ্ণা ভেঙে

মৃত্যুর লেলিহান শিখা জ্বেলে

সৃষ্টির অপার লীলায় প্রস্থানে মিশে

লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

চোখর মিছিল দেখেনা আত্মার প্রলাপ...


 


৫.

∆ রঙছবির ধাঁধাঁ ∆

 


আচ্ছা, তোমাদের সুন্দর মুখোশের পেছনে

লুকিয়ে থাকা মনটাও কি সুন্দর?

তোমরা যা নিঃশব্দে উচ্চারণ করো

তার মাঝে কি কল্যাণ লুকিয়ে থাকে?

নাকি অন্তর্জামির সাথেও অভিনয় করে যাও

সুনিপুন মিথ্যের অভিনব কৌশলে?

তবে কেনো পৃথিবীকে এতো বিষাদ মনে হয়

তবে কেনো পৃথিবীর প্রাণ মানুষে এতো ভেদাভেদ?

পুড়ে পুড়ে রক্তাভ লাল বর্ণ ধারণ করে দৃশ্যত 

সবুজ

পুরোটা আকাশ ছেয়ে যায় ধুমায়িত চিৎকার

পাখিপোড়া আর্তনাদে ঘুম ভেঙে ছোটে মানুষ

ধ্বংশ হতে হতে মৃতপ্রায় আশ্রয় চেয়ে থাকে

করুন চোখের কান্নাভেজা ছবির রঙদৃশ্যে

ক্যামের ক্লিক ক্লিক ছন্দ ভাসে নির্মোহ বাতাসের 

গায়ে

তোমাদেরও কি কান্না পায় হে দৃশ্যশিকারী






ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


মৃত্যুঞ্জয় রায় এর কবিতা-





১.
∆  জাহাজ সঙ্গ ∆



আমার স্তনদ্বয়ের মাঝে নেশাগ্রস্ত জাহাজ এসে ডুবল 
তাঁর আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লেগেছিল শ্যাওলা,
কেন জানি না আমার ইচ্ছেই হল না দূরে ঠেলে দিই আগন্তুককে |
সমুদ্রের নোনা জল আমার নাভিমূলে ছলাৎ করে উঠল,
সাদা সাদা ফ্যানা, চ্যাটচেটে 
আমার চারপাশে গভীর সমুদ্রের রঙীন মাছ
ভেসে যাচ্ছে মরা শামুকের খোলোস|  
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না
কারা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রাতভোর জাহাজের গায়ে ছেদা করেছিল? কারা?
মাঝ সমুদ্র থেকে টানতে টানতে জাহাজটাকে কারা আমার বুকের উপর আছড়ে ফেলল? কারা?
আমার বুকের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চোরা বালির স্তর
জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে গেলে সেটা তুলে আনা বড় কঠিন |
বড় কঠিন |




২.
∆  য ব নি কা   প ড়ে ছে ∆




আরও বেশি রোমাঞ্চকর
নক্ষত্র শরীর থেকে
গড়িয়ে পড়ছে বিশল্যকরণীর রস,
খিমচে ধরা জামার নিচে নিঃশব্দ সাইরেন
সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে সকলের মুক্তিপথ|
অসুখের সঙ্গে আপোষ করে আমরা নামছি রক্তডোবায়,
পার্শ্বচরিত্র গুলো পাশ ফিরে যায় বলেই
পূর্ণিমার চাঁদ কাস্তে হয়ে যায়|
হদিস পাইনি আজও
সমতলে দাঁড়িয়ে পাহাড় টাকে যারা  বিশ্বাসঘাতক বলেছিল!
প্রতিদিন গোপনে গোপনে আদর কিনছি টাকার বিনিময়ে 
তারপর বিচ্ছিরি স্বভাবে জলকোষের ভেতরে আশ্রয় খুঁজছি,
ভাঙা মাস্তুল 
জাহাজের পাটাতনের ছিদ্র দিয়ে উঠে এসেছিল জল,
সব নিষিদ্ধ পথ খোলা
সহজ কথা সহজভাবে বলতে শিখিনি বলে 
আবর্জনার স্তূপে সাজানো হয়েছে চিতা| 
আকাশে উড়ছে শফেদ শঙ্খিনী
স্বভাব স্বপ্ন সুধা,
প্রতি রাতে বাবুদের প্রেমের পর শুকিয়ে যায় রাংতায় মোড়ানো রজনীগন্ধা|

শরীরের ঘাম
শরীরের গন্ধ
শরীরের খেলা
শরীর মগ্ন
শরীরে ঢালছি ঘি
আগুন ঝলসে উঠবে আরও 

আছড়ে পড়া ঢেউ বন্ধু নয় সুখের,
ডিম্বাণুর চক্রব্যুহ ভেদ করে
কোনো রহস্য উন্মোচিত হয়নি
তার আগেই বিশ্বাসের মুখে যবনিকা পড়েছে|




৩.
∆ ধ্রুবতারা পুড়ছে ∆



ইতস্তত করতে করতে ধ্রুবতারাটি গোত্তা খেয়ে পড়ল পাহাড়ের উপর 
শূন্যের দিকে চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে পাহাড়,
কত যুগ পর আকাশ টাকে অসহায় দেখাচ্ছে
আত্ম অহঙ্কারের মুকুট যেন গড়িয়ে পড়েছে|
যদিও এই শূন্যস্থান স্থায়ী নয়
তবুও অস্বস্তিকর,
বুকের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠলো
আকাশের কাছ থেকে শেষ সম্বল টুকু কেড়ে নিয়ে বাতাস আছড়ে ফেলল ধ্রুবতারাটি |
এক মুহূর্ত শান্তি নেই 
কখনও মেঘে মেঘে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে 
কখনও লাট্টুর মতন পাক খেতে খেতে সর্বশক্তি সঞ্চিত হাওয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে সবটুকু,
ধ্রুবতারার মৃত্যু ঘোষণা আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা|
কোন বিচার সভায় বিচার হবে? 
যিনি মহান দার্শনিক তিনি দর্শন বদলে দক্ষ জিভ দিয়ে চেটে ফেলছে চামড়ার জুতো,
সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকেছে প্রবাসী মাতব্বর
বুদ্ধিজীবি মহল ভাগাড়ে বসে শুধু আলোচনা সভাই করছে,
অন্যদিকে কোকেন আর কয়লার জুয়াড়ি ঠিক করে দিচ্ছে কোন পথে এগোবে বিচার |
ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে উর্বর অস্তিত্ব
চোরাপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে চোখ আর কণ্ঠ
আগে যে মাঠে সোনার ফসল ফলত এখন সেখানে শশ্মানের কান্না শুনতে পাচ্ছি,
একটা ধ্রুবতারা পুড়ছে 
পুড়ছে নিষ্প্রয়োজন আমি|




৪.
∆ আমার প্রেমিকার নাম ∆




আমার ঘুমের মধ্যে যে আমার পিঠে ছুরি মেরেছিলো
সে আমার পরিচিত কেউ,
ন্যূনতম শব্দ ছিল না পায়ের
ভয়ঙ্কর সতর্কতায় আমার ঘরে ঢুকেছিল|
আমার ক্ষত বিক্ষত পিঠ
আমি ছটফট করছি
আমার মনে হচ্ছে
আমার গলার কাছে মাংসপিন্ড দলা পাকিয়ে আছে,
চিৎকার করার শক্তিটুকুও নেই|
দিনের আলোতে আমাকে পাকড়াও করার হিম্মত যার ছিল না
আমি নিশ্চিত সেই  ছিল আমার ছায়াসঙ্গী,
প্রতি মুহূর্তে আমার গতিবিধির উপর নজর ছিল 
ঘাপটি মেরেছিল সঠিক সময়ের অপেক্ষায়|
পড়শির ঘরের আগুন পরিচিত হয়েও যেমন বন্ধু নয় ফুলকি ছিটকে এসে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিতে পারে সেও ঠিক তেমন পরিচিত,
তাঁর মুখ স্পষ্ট মনে পড়ছে কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁর নাম বলব না|
তাঁর উদ্দেশ্য কেবল এক প্রেমিককে হত্যা করা 
কারণ বর্ষার ঋতু চলে যাওয়ার পর বৃষ্টির ঘ্রাণ মুছে দিতেই এই চক্রান্ত 
অপরিচিত কেউ নিশ্চয়ই জানবে না যে বৃষ্টি আমার প্রেমিকার নাম |




৫.
∆ দ র জা য়  এ ল  চাঁ দ ∆



কেঁপে উঠল মোমের আগুন 
দরজার কাছে চাঁদ এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম,
হাতে জোনাকির লণ্ঠন|
আমি যে তৃষ্ণার্ত সে কথা ওকে কে বলল?
চাঁদে কি জল আছে?
সে বিষয়ে কি বলছে বিজ্ঞান মহল?
জল যদি থেকেও থাকে
সেই জলে যে বিষ নেই তার কি কোনো প্রমাণ পত্র বা দলিল আছে?
শূন্য থেকে শূন্যে ভেসে গেলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমে যায়
কিন্তু চাঁদের নরম শরীরে মায়ার আকর্ষণ আছে,
আমি সেটা অনুভব করছি|
আমার কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে চাঁদ
আমি এক ফুট উঁচু থেকে স্পষ্ট দেখছি পৃথিবী বৃহস্পতির খুব কাছে চলে এসেছে কিন্তু দুই গ্রহের কক্ষপথে এক সমুদ্র দূরত্ব,
হঠাৎ উত্তাল সমুদ্র
শো শো হাওয়ার শব্দ
ঢেউয়ের মতন ঘাম গড়াচ্ছে চোরা পথে 
মহাকাশে মৃত্যুঞ্জয় তান্ডব,
চাঁদ মাটিতে এসে নামতেই
গোটা বিশ্ব অন্ধকার
সপ্তর্ষিমন্ডল যেন বর্শি
দূর থেকে ধেয়ে এসে গেঁথে যাবে বুকে,
শ্বাসযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়বে|
সর্বনাশ হওয়ার আগে 
আমি নত হব বিশ্বের চৌকাঠে
চাঁদ যতই বাহানা খুঁজুক আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার,
সেই স্পর্ধায় মোম গলে যাওয়ার আগে 
ওর হাত ধরে মহাকাশে ওকে ওর অবস্থানেই ফিরিয়ে দেব।



অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া’র কবিতা-








১.
∆ ছায়া ∆



উলু দিল ধানদুব্বো
শাদা থোড়ের মত ভারি পায়ের গোছ দেখে
আরশির মাথা ঘুরছিল
আয়না আয়না বলে ডাকে কেন ওরা?
রাগ ধরতো বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম প্রায়ই
বুঝতো না কেউ অবশ্য
বরাবরের মতোই মোটা শেকলে
আমার ছায়া বাঁধা থাকতো কাচের গায়
শরতশশী বলে ঠাকুমার ছবির সঙ্গে মেলাতো সবাই
রাঙা এসে ঠাট্টা করত খুব
শেষবার ফিরলাম যখন,ওরা সন্দেহ করে বসলো
কাচের ওধারে লম্বা সরু রাতকে
গর্ভিনী জেনে ভিড় করে এল  অসময়
রূপোর বাসনে পোড়া শোলমাছ বেড়ে দিলে
কানকোর লাল দেখে বমি হয়ে গেল সবুজ তাঁতের শাড়ি,
ফুলকারি রেকাবিসমেত মেয়েলি হাসির সাধভক্ষন
খন্ড খন্ড আনন্দ দৃশ্য বেরিয়ে এল টক জলের সাথে
বাব্বা! তলপেটের এই ঘূর্ণি ঢাকা যায় বলো?
আঁচল সরাতেই টানা নথে জল ভেঙে গেছে
ফোলা পেট নিয়ে ঘিরে আছে সধবারা,
হাতে খেজুরফুলের শরবত, নেশা হয় খেলে,
রক্তাভ চোখে দেখি আকাশের নীল দর্পনে
সন্ধের গায় গায় বেঁধে রাখা স্বর্ণ গোধিকা
পোয়াতি রাতের ভারি ঠিলে উল্টে প্রসব করেছে
লালাজড়ানো  হাজার হাজার মরা প্রজাপতি
আয়নায় ফুল ফুটেছে…!





 ২.
∆ রাস্তা ∆



হাততালি থামতেই গুঞ্জন শুরু হল
কাঠের সিঁড়ি ধরে নেমে এলেন যখন
কোনাকুনি আলো এসে পড়লো
চশমার ঘোর কেটে গেল তক্ষুণি
ফাঁকা সিটগুলোও ভরে উঠলো ফের
হ্যাপি এণ্ডিং পছন্দ যাদের,আজন্ম বৃষ্টি দ্যাখেনি
বাতিল টিকিটের সাথে রেখে দেয় অমর চিত্রকথা,
গ্রীষ্মকাল,ডায়ানা পামারের সোনাবেলা..
বনফায়ার ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে  চুল্লির ধারে
জানেনা ছেড়ে দিচ্ছে দূরপাল্লার গাড়ি
মোরামের রাস্তা,নিচু স্টেশনবাড়ি
অপেক্ষায় বাঁধানো এক কৃষ্ণচূড়া
ঘুমের বার্থ থেকে একটু দূরেই
থেমে আছে শ‍্যাওলার ভাঙাঘাট
শুধু কপ্পুর জ্বালানো প্রদীপ ভেসে যাচ্ছে একলা
সরু তেলের বাতি হাতে এ গল্পও তবে রওনা হল
পাথুরে জলের চিরপথ...
পৌঁছবো বলে যেখানে শুরু করেছিলাম আমরা....






৩.
∆ মেরুন ডায়েরি ∆



বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে হবে আবার
ঘুমের বড়ি,শস্তা পার্লার আর লেবুজল
সন্ধেয়  হাঁটাও জরুরি নাকি
গতবারের চিঠিতে লেখা সমুদ্রঝড়
এবারেও আসবে না নিশ্চই
হালকা সুতির পোশাকে বেড়াতে যাবো আবার
সুস্বাদু ঘুমে শুয়ে পড়বে রাত
শুধু ফেরার সময় মনে করে
ডায়েরিটা নিয়ে যেও  তুমি
জাদু জানে মেরুন ডায়েরি,
নাম ধরে তিনবার ডাকে যেই
নিশি হয়ে ধারালো চুল খুলে দেয় অন্ধকার
শাদা বুকে মায়া এক আলো
উন্মাদ কথামালা খলবল জড়ায় এমন
মগজে ঝাঁক বেঁধে মৌমাছি ওড়ে
ধোঁয়া ওঠে তাবৎ মৌচাক ফুঁড়ে
মাথাভর্তি মধু আর মোম নিয়ে
লেখাদের ঘুম আসে বলো?
অক্ষর ঘুমোয় কখনো?





৪.
∆ চশমা ∆



দম আটকে আসতো বিকেলের
দূরত্ব বেড়ে গেলে খা খা করতো চশমা
শুরুতেই যার ঠিকানা হারানো এক চিঠি
বাতিল খামে লেখা ক’লাইন ছলছল করে
কেমন আছেন, দেখিনি কতদিন..
মামুলি কথার ফাঁকে মেঘ করে অমনি
আসলে জুলাইয়ের বুনো ঝড় সে বলতে চাইতো
ভুলে যাওয়ার আগেই সে বলতে চাইতো খুব
আর মনে পড়তো না
অথচ বিবাদ নাই কোনও
মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ উঠলেই স্বচ্ছ নেটের মতো চাকভর্তি আলো
নীচে তড়বড় করে চেনা মুহুর্ত...
উড়তে চায় বলে হুহু করে ওঠে
লিখতে গেলে যেমন হাত কাঁপে বড্ড
ত‍্যাড়াব‍্যাঁকা লেখা থেকে মৌমাছি উড়ে যায়
দ‍্যাখে চশমা নিজেই আলো কমিয়ে আনছে
মজাদার ভঙ্গি করছে ছায়া
টাটকা যুবকের হাসিতে দম আটকে আসে বিকেলের
শুধু চশমা থেকে রোজ জল পড়ে বলে
গোধূলির আবছা তাকে খুলে ফেলে অন্ধ হয়ে যায়…!





৫.
 ∆ পাথর জন্ম ∆




বালি খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা তুলে আনলাম
অচেনা শহর.. তার রাস্তা
শিলাখন্ডে চাঁদ উঠল যেদিন
এদিক ওদিক ছড়ানো ভুল থেকে তুলে আনলাম
স্পর্শকাতর আয়না, মায়াবী আঙুলছাপ
নমুনা সংগ্রহের একেবারে নিচে
থমথমে প্রাচীন সুড়ঙ্গের অভিমান
নর্তকী ও দীপদান ঘিরে তখনও উড়ছিল
ভাঙাপ্রাচীর,জোছনার খিলান,নগরের প্রধান দরোজা..
এ শহর বৃষ্টিহীন !
কাত হয়ে পড়ে আছে কলস ও গনস্নানাগার
নাচের মুদ্রায় পাথরের নারী পেরিয়ে আসছিলো
তামাটে দিগন্ত ও ধুধু অবকাশ
ফাঁকা চোখে সে তুলে ধরছিলো জলপাত্র
টর্চের আলো পড়তেই খসে গেল চোখ
ধুলোর আস্তরে চাপা পড়ে আছি কত অশ্রুযুগ
মরা নদীখাতে এত রক্তমেঘ দেখে হতবাক তুই
সিঁড়ির পর সিঁড়িতে মৃত প্রজাপতির স্তুপ,
চুলে জড়ানো হাড়ের মালা  ডিঙোতে গিয়েও
মনে পড়ছে না, তোর মনে পড়ছে না
তোর জন্য সে জন্মেও অপলক পাথর ছিলাম?





শিল্পী- প্রতাপ হালদার


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

Friday, 23 April 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৬

সুকৃতি কবিতা-





১.

∆ বিকার ∆



১।

একটি সকালবেলা সুঁচের মাথায়

গেঁথে থাকে সহজ গমনে।

দানের সহজ ভাষা ভ্রমে

করেছে চতুরমুখী তাই।


হরি আসে হরি যায়, আমাকে ধরে না।

আমিও অক্ষম হাতহীন…

ছেড়ে দিয়ে অনাবিল আনন্দ কুড়াই।


২।

চাকার উপরে কাটে অর্ধেক জীবন

বাকিটা চাকার তলে কেটে কেটে যায়।

দাগের চাদর সরে গেলে

কথা বলে মরণের গান।


বহুমুখী শ্রমিকের মতো দাম ওঠে

আকাশে তখন তবু প্রেমের বাজারে

অপবাদ জোনাকির আলোর মতন

জ্বলে শুধু পেছনের ঘরে।


জারে জারে দ্রবীভূত মুখ

কখনও অ‍্যাসিড আর কখনও ক্ষারের

রসে চাপে লিটমাস হয়ে আছি প্রায়।


রোগ ভোগ পাশ দিয়ে ঘোরে

আমাকে অচ্ছুৎ ভেবে হয়তো ছোঁয় না।


তবু আমি বেঁচে আছি অনাবিল প্রেমের বিকারে।



 



২.

∆ জরাসন্ধ ∆



আমার মাথায় আর কিছু আসছে না। 

ঢিলেঢালা সুতোর কৌটায়

কোথায় লুকিয়ে আছে সুঁই!

ভাঙা ব্লেড থাকতেও পারে।


আমি তবু সেলাইয়ের নামে

ভেবেছি নিয়তি দুই টুকরো আপেলে।

আসলে বাঁধতে গিয়ে নিচে

জরাসন্ধ হয়ে গেছি তার।


এইবার পর্যাপ্ত ভীমের কাছে 

একদিন মুছে যেতে হবে সেও জানি।

কৃষ্ণেরও বাঁশি যাবে থেমে।


এখন আসনে রাখা দেবী 

আমার প্রেমিকা।

মননে বসান দেবী বৌয়ের সতীন।




৩.

∆ ক্ষত ∆



গোয়েন্দা প্রবণ মন বেশি সৎ হয়ে গেলে 

কথা বলে ঘরের বেড়াল।

তাকে বেশি না তোলাই ভালো।


হয়তো তখন কোনও অদৃশ‍্য কুকুর টের পায়

নিজেরই শরীর থেকে ক্ষত পচা ঘ্রাণ।

হৃদয় আহত হয়, তবু বেঁচে থাকা 

যেন এক সই দুটো পায়ের উপরে।

চোখের ভিতরে মহাভিনিষ্ক্রমণ।


অগুন্তি পথের শেষে ঠিক একজন

আয়না চিবিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়।


আমরা আসলে তো সময় নষ্ট করার জন‍্যই 

কবিতা লিখছি, মনে হয়

অপেক্ষার নামে রেখে যাচ্ছি কাটা দাগ 

লুকোনো শরীরে।




৪.

∆ কুকথা ∆



কার কাছে ধরা দেব? কার কাছ থেকে যাব ছিঁড়ে!

হরিণের মধ‍্যাহ্ন ভোজন 

বেরসিক নদীর ওপারে গেলে থেমে

এই পার ভাবের ভবন।

কচি কচি পাতার বয়ানে

লেগে কুয়াশার যোনি চেরা আলো

ভাষা আরও প্রবল হয়েছে।


গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু সকল

হঠাৎ থমকে গেলে ফুঁয়ে

রোদনের জ্বালা নিয়ে দেহে

তবুও থমকে থাকে মোম।


কার রিং কার আঙুলে গড়ায় জানে

বুকের পাথর।

ধীরে ধীরে সব রং ক্ষয়ে যায়,

সব হাসি মুছে যায় গাঢ় সাদা একটি টেবিলে।


আমাকে ছাড়ে না নীল আলো, লাল আলো!

ক্ষণে ক্ষণে চাকার ঘর্ষণে

দূরত্ব মুছতে গিয়ে শেষে

সব ব‍্যাস ছোটো হয়ে গেছে কুকথায়।




৫.
∆ শোয়া ∆



কিছুটা অপূর্ণ থাকা ভালো।

সব পাওয়া হয়ে গেলে কিছুই থাকে না।


দ্রোহের নিরীখে অক্ষরেখা 

বেমানান হয়ে যায় দ্রাঘিমা শুলেই।


আমাকেও মনে হয় শুয়ে আছি

তোমাকেও শুয়ে আছো মনে হয়


গাছ পাখি আকাশ তারারা

সবাই পড়েছে পাশে শুয়ে


এমনই অনন্ত সব শোয়া

কেউ কারো ধারে কাছে নেই।






ছবি- অতীশ কুণ্ডু

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৬

মিজান হাওলাদার এর কবিতা-





১.

∆ একটু সুগন্ধের অন্বেষণ ∆



দুঃখের মুখোশ পরা যাযাবর শহর!

তোমার ধূলোর ধূসর গলিতে আহত হয়ে-

দূর বহু-দূর পথে ঘুরেছি।


পদতলে প্রাসাদের মত দুঃখ

একটু সুগন্ধের অন্বেষণে 

রসহীন পাথরের ভেতর আটকে যাচ্ছি

তোমার বাইরে ভেতরে যাওয়া আসা করে মরণ।


অনিশ্চিত আমি 

উঠে যাচ্ছি আলোর জঙ্গল থেকে

নিজেকে নিজের থেকে অত্যাচারে

উঠে যাচ্ছি দালচিনি রঙের গম্বুজগুলো থেকে

থমকে থাকা মানুষের ভীড় থেকে

ধারাবাহিক অনন্তের ভেতর।


স্মৃতিতে আগুন জ্বলে, দীর্ঘকাল

একটু সুগন্ধের অন্বেষণ

না পেলে কোনো অভিযোগ নেই;   

যদি পেয়ে যাই তা যেন আমাকে আনন্দ দেয়।





২.

∆ জাদু শব্দ ∆



  আমার মগজ বেয়ে শব্দ নামছে


সুখ 


     দুঃখ 


           হাসি


                 আনন্দ 


                        এমন রঙ বেরঙের নানান শব্দ


কিছু শব্দের হাতে হাত রেখে মাইল মাইল পথ  পেড়িয়ে বন্ধুত্বের বুনিয়াদ গড়ি—

কিছু শব্দের সাথে এলোমেলো বন বনান্তর উঁচুনীচু সরলবর্গীয় পথে পথে হেঁটে আমার দিক বেঁকে যায় দিকভ্রান্তপুর

   

আমার মগজ বেয়ে শব্দ নামছে

সাহসী 

        নমনীয়

                ভীরু 

                   এমন নানান শব্দের সাথে

তাল মিলিয়ে পাশাপাশি বাজি—

আমাকে শব্দে শব্দে বাজায়; তবুও শব্দের কাছাকাছি আরও একটু ঘন হয়ে বসি —


  আমার মগজ বেয়ে শব্দ নামছে—


     আগুন 


           পানি 


              হাওয়া


এমন নানান শব্দেরও আছে যৌনতা বোধ

তাঁরা লজ্জা পেয়ে উলঙ্গ হয়ে আমার সামনে- কাঁপতে থাকে

এসব না দেখার ভান করে

তুমি নামক জাদু শব্দ নিঃশ্বাসে চেপে জীবন গড়াগড়ি




৩.

∆ যা খুঁজে বেড়াচ্ছি ∆

 


বাতাসের হাড়মজ্জার ভেতর যেন ভাসমান  

স্বপ্ন আর মিঠে ভাবনাগুলি

পিছনে পবিত্র আগুন ঘাতকের তাড়া

অনন্তের উপর খোলাখুলি ভালোবাসা আমার। 


শোকগ্রস্ত মোমের পুতুল কাঁদতে কাঁদতে

ভেসে যায় মঙ্গলকলস

জমাটবাধাঁ সময়ে দুঃখ জিভ বাড়িয়ে দিয়েছে  

আগুনমোরগ গান গাইছে 

দীর্ঘশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস

নীল স্তব্ধতার মাঝে খোলাখুলি ভালোবাসা আমার। 


হাহাকারে একটানা কেঁদে যায়,

কেঁদে যায় মোমের পুতুল

স্বপ্ন দেখার অত্যাচার থেকে 

বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও

আর্তনাদ, আর্তনাদ

এক ফোঁটা অতল জলের মধ্যে খুঁজে যায়

খোলাখুলি ভালোবাসা আমার। 




৪.

∆ শপথ ∆ 



যখন বৃষ্টির মতো চোখের জল ঝরে

সেরে নিই জীবনের শুদ্ধতম স্নান।


এই ঈশ্বরহীন সময়ের কথা

আমি কাউকেই বলব না

সেকালের গোপন শপথ।




৫.

∆ পথিক ∆



তুমি কান্না নদীর তীরে

আনন্দকে খুঁজে বেড়াও রোজ

সে অজানা উৎসবে

কেউ রাখেনা বিষন্নতার খোঁজ।




ছবি- অতীশ কুণ্ডু

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০