Sunday, 19 July 2020

কবিতা

শাপলা পর্ব -৭

কবি সোমদেব চট্টোপাধ্যায় এর কবিতা-




১।।   ∆ চাঁদের গ্রহণ ∆



এক ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট সাতান্ন সেকেন্ড সময়
যেখানে যখন রক্তাক্ত চাঁদের দেখা পাওয়া গেল
পৃথিবী এক নির্বোধ শিশুর মত হাততালি দিয়ে উঠল
ওই দেখতে পাওয়া গেছে 
শতকের দীর্ঘতম গ্রহণ দেখতে পাওয়া গেছে
দেখে নাও প্রাণ ভরে দেখে নাও এইবেলা
বুদ্ধিজীবি কিছু, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে 
মেঘগুলোকে সরাতে লাগলেন
সেরা কলমচী, জ্যোতির্বিদ, জ্যোতিষী এবং ইতিহাসবিদ
শতকের রক্তাক্ত চাঁদ খুঁজে দেখলেন
যে যার নিজের নিজের মতন করে
কেউ একবারও মনে করলেন না
চৌদ্দ বছরের পূর্ণিমার কথা 
কেউ একটিবারের জন্যেও ভাবলেন না 
তাকে বাঁচাতে অসহায় মরিয়া এক মায়ের কথা
যিনি পশুদের কাছে কাতর ভিক্ষা চেয়েছিলেন, 
-আব্দুল... আব্দুল... দয়া কর
বাবা আলি... দুটি পায়ে পড়ি, দয়া কর
আমরা কাফের, তাও না হয় মেনে নিলাম
তোমরা একে একে এসো বাবা
মেয়েটা আমার বড়োই ছোট 
একসাথে এতজন হলে ও যে এক্ষুনি মরে যাবে ভাই ! 
না, কেউ তাতেও কর্ণপাত করেনি সেদিন
সতেরোটি পশুর একজনও নয়
বরং সারা রাত ধরে রক্তাক্ত করেছে সিরাজগঞ্জ 
সারাটা নির্মম রাত ধরে এবং এভাবেই 
শতকে দীর্ঘতম হয়েছে পূর্ণিমা চাঁদের গ্রহণ
কেউ একটিবারও বললেন না
এক ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট সাতান্ন সেকেন্ডের গ্রহণ 
আসলে কিছুই নয়
এদিকে নির্বাক এক পৃথিবীতে কেবলই হাততালি !





২।।   ∆ অন্তিম অশ্বমেধের ঘোড়া ∆



১.
রাজার মৃত্যুর পর প্রিয় রাজপথ যে রক্তময় 
তুমি কী ভাবছ বিলায়েৎ ? 
বিলায়েৎ বলল, 
লাল গালিচায় মুড়ে দেওয়া পথে
রক্তগোলাপ ফোটে
নতুন রাজা ও রাজপথ
হোলি উৎসবে মেতে ওঠে 

হর্ষোল্লাসে মৃত্যুর মুখ মিছিল মুছে যায়  
এভাবেই রাজসভার গঠন 
এবং অচিরেই... পুনরায় !



২. 
আস্তাবলের অন্তিম ঘোড়াটি এখনও যে 
জেগে আছে বিলায়েৎ !  
বিলায়েৎ বলল, 
পৃথিবীর কোনো যুদ্ধই আজ 
একেবারে শেষ নয়
মানুষ প্রান্ত বদলাতে থাকে
সাথে সব নিশানের রঙ
সে যে অশ্বমেধের ঘোড়া... 
তার একফালি চাঁদ নিজের মুঠোয়
সে জেগে থাকে নির্ভয় !


৩.
প্রকাশ্য দিন আর নিন্মগামী আলোকে 
জীবনের কী তফাৎ ঘটে বিলায়েৎ ? 
বিলায়েৎ মুখ ফেরায় 
-পুরুষ প্রথমটিতে সপ্রতিভ, 
দ্বিতীয়টিতে আরও বেশি 
নারী এখনও প্রধানতঃ রাতে 
এমনকি দিনে অথবা প্রভাতে
অথচ যে মানুষ মৃত্যু চায়, যে চায় রক্ত 
সে দিনেও  যত সাবলীল, সহজ তেমনই রাতে



৪.
বিলায়েৎ, তবে কি বিপদ থেকে মুক্তির 
কোনোই উপায় নেই ? 
বিলায়েৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে
-যদি সমস্ত পুরুষ এবং নারী অক্ষম হয় 
সমস্ত অশ্বারোহী ও পদাতিক বিফল
কেউ, কিছুই যদি না পারো 
যদি সভ্যতাকে টিঁকিয়ে রাখতে চাও, 
তবে অন্ততঃ আস্তাবলের দরজাটি খুলে দিও I





৩।।   ∆ বাজেয়াপ্ত কবিতাগুলি  ∆




তুমি বলেছিলে, এভাবে গণ অভ্যুত্থান চাই না !

অন্ধকার ভেদ করে ছুটে আসছিল মিশকালো বুলেট 
রাতের নদী পেরিয়ে কাঁকরভিটা পালাতে পালাতে 
একবার কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম 

অসমঞ্জদা, কেউ আমায় বিদ্রুপ করেনি তো ! 
 
তুমি বিশ্বাস করো, 
আমার বাজেয়াপ্ত কবিতাগুলোয় 
কেবল নিহত আদিবাসী রমণী, শিশুর কথা ছিল না 
কেবল সেই সব কৃষক নেতাদের কথাই ছিল না 
আমি হারিয়ে যাওয়া এক ঝাঁক উজ্জ্বল মেধাবী ছাত্রের কথা লিখেছিলাম 
যাদের কেউ কেউ নিরাপরাধ, দৃঢ়চেতা 
রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিল
আমি, সেই উর্দি পরা পুলিশটির কথাও লিখেছিলাম 
যার কাছে একটিও কার্তুজ পাওয়া যায়নি 
বরং একশত গ্রাম পেয়াঁজ পকেটে নিয়ে 
তার  রক্তাক্ত লাশখানি হ্যারিসন রোডে পড়ে ছিল 
কবিতায় আমি তার কথাও বলেছিলাম অসমঞ্জদা !

আমিও তোমার মতো বন্দুকের নলেই সমস্ত শক্তি দেখিনি 
তবুও সেই রাতে 
আমি এক দাগী আসামীর মত ছুটে পালিয়েছিলাম 

তুমি আমায় অন্ধ হতে শেখাওনি কেন ? 
রাজনৈতিক বুলি কানে দিয়ে 
কেন আমার পকেটে সিসে ভরে বলোনি, 
খতম কর শালাদের !

কেন বারংবার বলেছো কবিতা লেখ, কবিতা লেখ
আর আমি উন্মাদের মত লিখেছি 
রক্ত মাংস হাড় মজ্জা একাকার করে লিখেছি 


অনাহারে অনিদ্রায় পালিয়ে যেতে যেতেও 
তমসাচ্ছন্ন দিনের কথা লিখেছি 
যাতে তোমার মতোই সূর্যোদয় হয় কোথাও, কোনো সময় 

তুমি বলেছো বলেই অসমঞ্জদা, 
আজও প্রতিটি দুঃসময়ে কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয় 
এখনো স্থির বিশ্বাস রাখি 
ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে যেতে যেতেও 
মানুষ একবার উঠে দাঁড়াবেই 
আর ঠিক তখনই  
একজন কবিকে দেশদ্রোহী বলতে শাসকের ঠোঁট কেঁপে উঠবে 

এবং হয়তো তারাই একদিন সসংকোচে বলবে, 

এই রুগ্ন একগুঁয়ে ছেলেটি আসলে এক দুর্দান্ত প্রেমিক হতে চেয়েছিল মাত্র 
সামঞ্জস্যহীন, এক জন দেশপ্রেমিক 
ফিরিয়ে দাও এর বাজেয়াপ্ত কবিতাগুলি !




অলংকরণ - মেহবুব গায়েন

°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°°

No comments:

Post a Comment