Wednesday, 5 May 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


রঙ্গন রায় এর কবিতা-






∆ জানুয়ারি মাসের কবিতা ∆



প্রিয় কবির কবিতা পড়ছি
প্রথম দিক কার কবিতা 
তাঁর মেয়ের সাথে আমার 
এক অলৌকিক বন্ধুত্ব আছে 
কবিতায় ওর ছোটবেলা দেখা যাচ্ছে 
কবিতায় আমাদের অলৌকিক বন্ধুত্বের ছোটবেলা দেখা যাচ্ছে 



যেসব কবিতা গুলোয় তুমি আছো 
সেসব কবিতা তোমার বাবা পড়ে; 
বলে , এত সুন্দর কবিতা তুমি লেখো কী করে!

চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙে যায় 



করলা নদীর ধারে
সদর বালিকা বিদ্যালয় -
এই স্কুলে তুমি কোনোদিন পড়োনি 
তবুও সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে এখানে এলে 
তোমাকে তীব্র রূপসী মনে হয় 



যোগমায়া কালিবাড়ির চাতালে চশমা খুলে রাখো 
উত্তল লেন্সে মন্দির বড় হয়ে ওঠে 
বড় হওয়া লক্ষ্য করে তাকাই তোমার দিকে 
শ্বেতপাথরের মেঝেয় গোলাপী আঁচল 
ঈশ্বর ধন্য হয়ে ওঠে 



এই কবিতা গুলোর ভেতর তোমাকে রেখে দিলাম 
পৃথিবী জুড়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়বে




অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০



কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


কুশল ভৌমিক এর কবিতা-






১. 

∆ বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে ∆



বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে দ্বীপের গাম্ভীর্য নিয়ে
গুহায় ঘুমিয়ে পড়া অলস সময়
তবু স্থির কোন চিত্রকল্প এঁকে
কড়া নাড়ে বহুদিন না খোলা কাঠের কপাটে
ঝিঁঝিঁর ডাক,উত্তাপহীন জোনাকির আলো
আছড়ে পড়ে শ্যাওলা জমা প্রাচীন সিঁড়িতে।

মেহগনি পাতার ফাঁকে কেঁপে ওঠে চাঁদ
বৃষ্টিফোঁটার মতো জোছনার ছাই
টুপটাপ ঝরে পড়ে
পৌরাণিক পুকুরের জলে-
খলবল হেসে ওঠে খলিসা পুঁটি
দানকিনার ঝাঁক
বিষণ্ণ কানিবক পাহারা দেয় মায়ের শ্মশান
বাঁশঝারে কেঁদে ওঠে কানাকুহা
টিনের চালে আছড়ে পড়ে হুতুমপেঁচার দল।

টিনচালা দুটো ঘর হাত ধরে সারারাত হাঁটে
গল্প করে,অযাচিত আড়ালে ঠোঁটে আঁকে
মৌণচুম্বন।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো
বাড়িটি মেশে না কারো সাথে
ভেসে থাকে দিন রাত
ইতিহাসের ঘোলাটে ডোবায়

আমাদের বাড়িটায় মানুষের পদচিহ্ন নেই
উঠোনজুড়ে ঈশ্বর হাঁটে।




২.

∆ বেদনার হায়ারোগ্লিফিক্স ∆



এই যে আমি তোমার অবাধ্য ঠোঁটে
লেপ্টে দিলাম একটা কষ্টার্জিত দুপুর
আস্ত একটা কবিতার বই
বেদনার হায়ারোগ্লিফিক্স

এসবই আমার ক্ষুধার্ত প্রেমের নামতা।

যদি খুলতে পারো সমীকরণ
জীবনের ভগ্নাংশের ভাঁজ
দেখবে-

আকাশে ঝুলে আছে আইনস্টাইন
পাতার ভেতর খসে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ
আর পৃষ্ঠাজুড়ে লালনের একতারা
আর আমি-
ব্রহ্মান্ডের মতো তোমার খোলা পিঠে
দুলে ওঠা বেণির শিল্পকলা দেখে দেখে
প্রশ্নবোধক চিহ্নের ভেতর ঢুকিয়ে দিই বিস্ময়

জীবন বস্তুত বিরাম চিহ্নের মাস্তানি!



৩.

∆ প্রত্যয় ∆



সূর্যটাকে দখল করেছে মালটি-কালার সময়
অন্ধকারের আচ্ছাদনে মরে গেছে রোদের প্রতিভা দ্বিধার দুপুরে
মায়ের উনুনে ভাত ফোটার গন্ধ
এটুকুই কেবল শান্তি আমাদের।

কবিতার বীজ পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে
মাফিয়ারা
যেখানে পুঁতবে সেখানেই জন্ম নেবে কবিতাবৃক্ষ!
মাফিয়া এবং কবিতা
দু'য়ে মিলে অদ্ভুত স্থাপত্যকলা
এরিস্টটল প্লেটো বলে দিন;বলে দিন-
পোয়েট্রি এবং পলিটিক্স সমার্থক শব্দ কি না?

হোঁচট খেলে মানুষ সতর্ক হয়
সৎ ও সতর্কতা বিপরীত শব্দ জেনে
উপভোগ করি উঠে দাঁড়াবার আনন্দ।

হোঁচট খেয়ে যে হাসতে জানে

পরাজয় তার  সিলেবাসে থাকে না কোনোদিন।




৪.

∆ জীবনানন্দ ∆



যতবার মানুষ হতে চেয়েছি
কীভাবে কীভাবে যেন ততবার
হয়ে গেছি দুর্বোধ্য পান্ডুলিপি
শরীর বিদীর্ণ করা কালো অক্ষর
তাই আশ্রয় পায়নি
প্রেমিকার ফর্সা আঙ্গুলে।

সবিতা,সুরঞ্জনা, সুচেতনা
সচেতনভাবেই
উপেক্ষার চাদর বিছিয়ে
মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।
মলাটবন্দি হবার আকাঙ্ক্ষাগুলো
দুঃখে অপমানে লজ্জায়
বন্দি হয়েছে মরচে পড়া লোহার বাক্সে
উঁকি দেবার ঝুঁকিটুকু নেয়নি।
শ্রীহীন জীবনে লাবণ্য থেকেছে অধরা
কাছে থেকেও দূরের আক্ষেপে
আমি কতবার মরে গেছি।

নিঃসঙ্গ চিলের মতো
কেঁদে কেঁদে উড়ে গেছি এ ঘাট থেকে ও ঘাটে
ফেরি করেছি  বিপন্ন বিস্ময়
মন্দাক্রান্ত বিষণ্ণতা অথবা দুঃখ
এসবই আমার নাম হতে পারতো
অথচ আমার নাম জীবনানন্দ!

কয়েকটা কবিতার বিনিময়ে
তোমরা কেউ নেবে এমন একটা জীবন?



৫.

∆ নেই ∆



মায়ের গর্ভের চেয়ে বড় কোনো দেশ
ভালোবাসার চেয়ে বড় কোনো মাতৃভাষা
ক্ষুধার চেয়ে বড় কোনো সার্বজনীনতা
চোখ থেকে চোখ সরে যাবার চেয়ে বড় কোনো দূরত্ব
নিজের চেয়ে বড় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী
তোমার খোপার চেয়ে বড় কোনো ফুলদানি

নেই।নেই।নেই।






ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


মাহফুজ মুজাহিদ এর কবিতা-





১.

∆ হৃদয়  জংশন ∆

 


কিছু দুঃখ দাঁড়ানো আছে জংশনে

সিগনাল পেলে দৌঁড়ে যাবে

ভুল গন্তব্য ফিরিয়ে দেবে আবার

ছেড়ে যাওয়া জংশনের কাছে

কখনোই ভালো সিগনালম্যান ছিলাম না

কোনোদিন লাইনম্যান হয়ে পৌঁছে যাবো

ভুল করে জংশনে দাঁড়ানো দুঃখের সাথে

তোমার দরোজা খোলা রবে ট্রেনের দুপাশে

যেমন থাকে আগমন ও প্রস্থানের আঁড়াল

তবুও আমি প্রকাশ্যে বাড়াবো হাত

একান্ত কিছু দুঃখ লুকোবার

জংশনে জংশনে অনেক দুঃখ কুড়িয়েছি

স্টেশনে নামাবো বলে; তুমিহীন এ পৃথিবীর

কোথায় আছে সেই সে স্টেশন?


 

২.

∆ রক্তছায়ার হাত ∆

 

হাত

পানিরূপ লালে ভিজতে ভিজতে কবেই

মেঘগুলো সাদা থেকে লাল থেকে কালো

হতে হতে একদিন সবুজের দিকে চেয়ে

নিঃসঙ্গ ডাহুকের মতোন ডেকে ওঠে

প রি ত্রা ণ...

স্বপ্ন জেগে ওঠে

রাতের ঘুম থেকে বুকের ওম-খাঁচায়

ধনুক ছিলায় বাণ গেঁথে গেঁথে একদিন

শত্রুর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছি এই হাতে

পরম আদরে মাটির প্রলেপের মতোন

নিজের বুক জ্বলে গেলে কেউ শতবুকে

জ্বালাতে পারে দহনের সুখ গোপন অসুখে

উ ত্থা ন...

পতনের শব্দ

চমকে ওঠে বৃক্ষের খোলস

তক্ষক ডেকে যায় উত্তাপ দুপুরে একা

রক্তের লালসা ঝরে; দিগন্তজুড়ে ভয়ে

ডালে ডালে শকুন চেয়ে থাকে ডানামেলা

অন্ধ সময়ের ঢের আগে; অহেতুক শান্তনা

ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে রক্ত-মাংসের ঘ্রাণে

হা হা কা র...

পেট পুড়লে

মন ও মগজে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদ

থু মেরে দুরে ফেলি মিথ্যের বৈভবে আঁকা

আঁকা-বাঁকা মানচিত্রের জ্বলজ্বলে সাদাভাত

প্র তি বা দ...


 


৩.

∆ হঠাৎ নিশ্চুপে ∆

 


তুমি ছিলে?

তুমি কোথায় ছিলে?

তুমি কখন ছিলে?

কেনো ছিলে?

পৃথিবীর পথে, ঘাসের সবুজে,

রক্তবর্ণ ঠোঁটে, নীল জমিনে সাদার ভেতর

সকালের কোমল রোদে, বৃষ্টির ভেজা দুপুরে

শেষ বিকেলের সোনালী আলোয় কিংবা

কিশোরীর চুলখোলা কোনো স্নিগ্ধ বাতাসে

বসন্ত দুপুর, শ্রাবণ বিকাল, শীতের ভোর

রাতের অন্ধকার, সুবিশাল উদ্যান

কয়েকশত বছর খুঁজেছি তোমায়

তুমি ছিলে?

তুমি কোথায় ছিলে?

তুমি কখন ছিলে?

কেনো ছিলে?

তুমি কেমন ছিলে?

একবার; তোমাকে একবার দেখবো বলে

ফিরিয়ে দিয়েছি চাঁদমাখা আদরের ঘুম

শুধু তোমাকে দেখবো বলে

শৈশব লাটিমে ঘুরেছি দুপুর-বিকাল, সন্ধ্যা-সকাল

একবার; তোমাতে হারাবো বলে

বিশ কোটি ভালোবাসা ফেলে ফিরে আসি বারবার

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই এসেছিলে পৃথিবীতে 

একদিন

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই ভালোবেসে অন্ধকারের 

দিন

তুমি এসেছিলে; নিশ্চই দিনের কোলাহল ফুরালে আবার

দাঁড়াবে এসে শিয়রের উত্তাপে একদিন


 

 

৪.

∆ অনন্ত বিদায়ের মিছিলে ∆

 


লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

মানুষ হেঁটে যায়-- বিদায় বিদায়

কালেমায়, হরিবোল, ঈশ্বরের নামে

লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

অগণিত ক্লান্ত দিনের কথা হেরে যায়

হেঁটে যেতে যেতে মানুষের পা

তবুও ফুরোয়না পথ; দিগন্ত উদার

রোদ-বৃষ্টি-শীতে মানুষ হেঁটে যায়

মানুষ হেঁটে যায় কবরে-শ্মশানে

হেঁটে যেতে যেতে বিদায় জানায়

অন্তিম দিনের ব্যথা ভুলে ফিরে আসে

শোকের উদোম তৃষ্ণা ভেঙে

মৃত্যুর লেলিহান শিখা জ্বেলে

সৃষ্টির অপার লীলায় প্রস্থানে মিশে

লাশের মিছিলে মানুষ হেঁটে যায়

চোখর মিছিল দেখেনা আত্মার প্রলাপ...


 


৫.

∆ রঙছবির ধাঁধাঁ ∆

 


আচ্ছা, তোমাদের সুন্দর মুখোশের পেছনে

লুকিয়ে থাকা মনটাও কি সুন্দর?

তোমরা যা নিঃশব্দে উচ্চারণ করো

তার মাঝে কি কল্যাণ লুকিয়ে থাকে?

নাকি অন্তর্জামির সাথেও অভিনয় করে যাও

সুনিপুন মিথ্যের অভিনব কৌশলে?

তবে কেনো পৃথিবীকে এতো বিষাদ মনে হয়

তবে কেনো পৃথিবীর প্রাণ মানুষে এতো ভেদাভেদ?

পুড়ে পুড়ে রক্তাভ লাল বর্ণ ধারণ করে দৃশ্যত 

সবুজ

পুরোটা আকাশ ছেয়ে যায় ধুমায়িত চিৎকার

পাখিপোড়া আর্তনাদে ঘুম ভেঙে ছোটে মানুষ

ধ্বংশ হতে হতে মৃতপ্রায় আশ্রয় চেয়ে থাকে

করুন চোখের কান্নাভেজা ছবির রঙদৃশ্যে

ক্যামের ক্লিক ক্লিক ছন্দ ভাসে নির্মোহ বাতাসের 

গায়ে

তোমাদেরও কি কান্না পায় হে দৃশ্যশিকারী






ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭


মৃত্যুঞ্জয় রায় এর কবিতা-





১.
∆  জাহাজ সঙ্গ ∆



আমার স্তনদ্বয়ের মাঝে নেশাগ্রস্ত জাহাজ এসে ডুবল 
তাঁর আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লেগেছিল শ্যাওলা,
কেন জানি না আমার ইচ্ছেই হল না দূরে ঠেলে দিই আগন্তুককে |
সমুদ্রের নোনা জল আমার নাভিমূলে ছলাৎ করে উঠল,
সাদা সাদা ফ্যানা, চ্যাটচেটে 
আমার চারপাশে গভীর সমুদ্রের রঙীন মাছ
ভেসে যাচ্ছে মরা শামুকের খোলোস|  
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না
কারা বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রাতভোর জাহাজের গায়ে ছেদা করেছিল? কারা?
মাঝ সমুদ্র থেকে টানতে টানতে জাহাজটাকে কারা আমার বুকের উপর আছড়ে ফেলল? কারা?
আমার বুকের দৈর্ঘ্য প্রস্থ চোরা বালির স্তর
জাহাজটা পুরোপুরি ডুবে গেলে সেটা তুলে আনা বড় কঠিন |
বড় কঠিন |




২.
∆  য ব নি কা   প ড়ে ছে ∆




আরও বেশি রোমাঞ্চকর
নক্ষত্র শরীর থেকে
গড়িয়ে পড়ছে বিশল্যকরণীর রস,
খিমচে ধরা জামার নিচে নিঃশব্দ সাইরেন
সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে সকলের মুক্তিপথ|
অসুখের সঙ্গে আপোষ করে আমরা নামছি রক্তডোবায়,
পার্শ্বচরিত্র গুলো পাশ ফিরে যায় বলেই
পূর্ণিমার চাঁদ কাস্তে হয়ে যায়|
হদিস পাইনি আজও
সমতলে দাঁড়িয়ে পাহাড় টাকে যারা  বিশ্বাসঘাতক বলেছিল!
প্রতিদিন গোপনে গোপনে আদর কিনছি টাকার বিনিময়ে 
তারপর বিচ্ছিরি স্বভাবে জলকোষের ভেতরে আশ্রয় খুঁজছি,
ভাঙা মাস্তুল 
জাহাজের পাটাতনের ছিদ্র দিয়ে উঠে এসেছিল জল,
সব নিষিদ্ধ পথ খোলা
সহজ কথা সহজভাবে বলতে শিখিনি বলে 
আবর্জনার স্তূপে সাজানো হয়েছে চিতা| 
আকাশে উড়ছে শফেদ শঙ্খিনী
স্বভাব স্বপ্ন সুধা,
প্রতি রাতে বাবুদের প্রেমের পর শুকিয়ে যায় রাংতায় মোড়ানো রজনীগন্ধা|

শরীরের ঘাম
শরীরের গন্ধ
শরীরের খেলা
শরীর মগ্ন
শরীরে ঢালছি ঘি
আগুন ঝলসে উঠবে আরও 

আছড়ে পড়া ঢেউ বন্ধু নয় সুখের,
ডিম্বাণুর চক্রব্যুহ ভেদ করে
কোনো রহস্য উন্মোচিত হয়নি
তার আগেই বিশ্বাসের মুখে যবনিকা পড়েছে|




৩.
∆ ধ্রুবতারা পুড়ছে ∆



ইতস্তত করতে করতে ধ্রুবতারাটি গোত্তা খেয়ে পড়ল পাহাড়ের উপর 
শূন্যের দিকে চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে পাহাড়,
কত যুগ পর আকাশ টাকে অসহায় দেখাচ্ছে
আত্ম অহঙ্কারের মুকুট যেন গড়িয়ে পড়েছে|
যদিও এই শূন্যস্থান স্থায়ী নয়
তবুও অস্বস্তিকর,
বুকের ভেতরটা ঝনঝন করে উঠলো
আকাশের কাছ থেকে শেষ সম্বল টুকু কেড়ে নিয়ে বাতাস আছড়ে ফেলল ধ্রুবতারাটি |
এক মুহূর্ত শান্তি নেই 
কখনও মেঘে মেঘে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বৃষ্টি ঝড়ে পড়ছে 
কখনও লাট্টুর মতন পাক খেতে খেতে সর্বশক্তি সঞ্চিত হাওয়া তুলে নিয়ে যাচ্ছে সবটুকু,
ধ্রুবতারার মৃত্যু ঘোষণা আর কিছুক্ষনের অপেক্ষা|
কোন বিচার সভায় বিচার হবে? 
যিনি মহান দার্শনিক তিনি দর্শন বদলে দক্ষ জিভ দিয়ে চেটে ফেলছে চামড়ার জুতো,
সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে ঢুকেছে প্রবাসী মাতব্বর
বুদ্ধিজীবি মহল ভাগাড়ে বসে শুধু আলোচনা সভাই করছে,
অন্যদিকে কোকেন আর কয়লার জুয়াড়ি ঠিক করে দিচ্ছে কোন পথে এগোবে বিচার |
ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে উর্বর অস্তিত্ব
চোরাপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে চোখ আর কণ্ঠ
আগে যে মাঠে সোনার ফসল ফলত এখন সেখানে শশ্মানের কান্না শুনতে পাচ্ছি,
একটা ধ্রুবতারা পুড়ছে 
পুড়ছে নিষ্প্রয়োজন আমি|




৪.
∆ আমার প্রেমিকার নাম ∆




আমার ঘুমের মধ্যে যে আমার পিঠে ছুরি মেরেছিলো
সে আমার পরিচিত কেউ,
ন্যূনতম শব্দ ছিল না পায়ের
ভয়ঙ্কর সতর্কতায় আমার ঘরে ঢুকেছিল|
আমার ক্ষত বিক্ষত পিঠ
আমি ছটফট করছি
আমার মনে হচ্ছে
আমার গলার কাছে মাংসপিন্ড দলা পাকিয়ে আছে,
চিৎকার করার শক্তিটুকুও নেই|
দিনের আলোতে আমাকে পাকড়াও করার হিম্মত যার ছিল না
আমি নিশ্চিত সেই  ছিল আমার ছায়াসঙ্গী,
প্রতি মুহূর্তে আমার গতিবিধির উপর নজর ছিল 
ঘাপটি মেরেছিল সঠিক সময়ের অপেক্ষায়|
পড়শির ঘরের আগুন পরিচিত হয়েও যেমন বন্ধু নয় ফুলকি ছিটকে এসে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিতে পারে সেও ঠিক তেমন পরিচিত,
তাঁর মুখ স্পষ্ট মনে পড়ছে কিন্তু প্রকাশ্যে তাঁর নাম বলব না|
তাঁর উদ্দেশ্য কেবল এক প্রেমিককে হত্যা করা 
কারণ বর্ষার ঋতু চলে যাওয়ার পর বৃষ্টির ঘ্রাণ মুছে দিতেই এই চক্রান্ত 
অপরিচিত কেউ নিশ্চয়ই জানবে না যে বৃষ্টি আমার প্রেমিকার নাম |




৫.
∆ দ র জা য়  এ ল  চাঁ দ ∆



কেঁপে উঠল মোমের আগুন 
দরজার কাছে চাঁদ এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম,
হাতে জোনাকির লণ্ঠন|
আমি যে তৃষ্ণার্ত সে কথা ওকে কে বলল?
চাঁদে কি জল আছে?
সে বিষয়ে কি বলছে বিজ্ঞান মহল?
জল যদি থেকেও থাকে
সেই জলে যে বিষ নেই তার কি কোনো প্রমাণ পত্র বা দলিল আছে?
শূন্য থেকে শূন্যে ভেসে গেলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমে যায়
কিন্তু চাঁদের নরম শরীরে মায়ার আকর্ষণ আছে,
আমি সেটা অনুভব করছি|
আমার কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে চাঁদ
আমি এক ফুট উঁচু থেকে স্পষ্ট দেখছি পৃথিবী বৃহস্পতির খুব কাছে চলে এসেছে কিন্তু দুই গ্রহের কক্ষপথে এক সমুদ্র দূরত্ব,
হঠাৎ উত্তাল সমুদ্র
শো শো হাওয়ার শব্দ
ঢেউয়ের মতন ঘাম গড়াচ্ছে চোরা পথে 
মহাকাশে মৃত্যুঞ্জয় তান্ডব,
চাঁদ মাটিতে এসে নামতেই
গোটা বিশ্ব অন্ধকার
সপ্তর্ষিমন্ডল যেন বর্শি
দূর থেকে ধেয়ে এসে গেঁথে যাবে বুকে,
শ্বাসযন্ত্র অকেজো হয়ে পড়বে|
সর্বনাশ হওয়ার আগে 
আমি নত হব বিশ্বের চৌকাঠে
চাঁদ যতই বাহানা খুঁজুক আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার,
সেই স্পর্ধায় মোম গলে যাওয়ার আগে 
ওর হাত ধরে মহাকাশে ওকে ওর অবস্থানেই ফিরিয়ে দেব।



অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৭

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া’র কবিতা-








১.
∆ ছায়া ∆



উলু দিল ধানদুব্বো
শাদা থোড়ের মত ভারি পায়ের গোছ দেখে
আরশির মাথা ঘুরছিল
আয়না আয়না বলে ডাকে কেন ওরা?
রাগ ধরতো বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতাম প্রায়ই
বুঝতো না কেউ অবশ্য
বরাবরের মতোই মোটা শেকলে
আমার ছায়া বাঁধা থাকতো কাচের গায়
শরতশশী বলে ঠাকুমার ছবির সঙ্গে মেলাতো সবাই
রাঙা এসে ঠাট্টা করত খুব
শেষবার ফিরলাম যখন,ওরা সন্দেহ করে বসলো
কাচের ওধারে লম্বা সরু রাতকে
গর্ভিনী জেনে ভিড় করে এল  অসময়
রূপোর বাসনে পোড়া শোলমাছ বেড়ে দিলে
কানকোর লাল দেখে বমি হয়ে গেল সবুজ তাঁতের শাড়ি,
ফুলকারি রেকাবিসমেত মেয়েলি হাসির সাধভক্ষন
খন্ড খন্ড আনন্দ দৃশ্য বেরিয়ে এল টক জলের সাথে
বাব্বা! তলপেটের এই ঘূর্ণি ঢাকা যায় বলো?
আঁচল সরাতেই টানা নথে জল ভেঙে গেছে
ফোলা পেট নিয়ে ঘিরে আছে সধবারা,
হাতে খেজুরফুলের শরবত, নেশা হয় খেলে,
রক্তাভ চোখে দেখি আকাশের নীল দর্পনে
সন্ধের গায় গায় বেঁধে রাখা স্বর্ণ গোধিকা
পোয়াতি রাতের ভারি ঠিলে উল্টে প্রসব করেছে
লালাজড়ানো  হাজার হাজার মরা প্রজাপতি
আয়নায় ফুল ফুটেছে…!





 ২.
∆ রাস্তা ∆



হাততালি থামতেই গুঞ্জন শুরু হল
কাঠের সিঁড়ি ধরে নেমে এলেন যখন
কোনাকুনি আলো এসে পড়লো
চশমার ঘোর কেটে গেল তক্ষুণি
ফাঁকা সিটগুলোও ভরে উঠলো ফের
হ্যাপি এণ্ডিং পছন্দ যাদের,আজন্ম বৃষ্টি দ্যাখেনি
বাতিল টিকিটের সাথে রেখে দেয় অমর চিত্রকথা,
গ্রীষ্মকাল,ডায়ানা পামারের সোনাবেলা..
বনফায়ার ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে  চুল্লির ধারে
জানেনা ছেড়ে দিচ্ছে দূরপাল্লার গাড়ি
মোরামের রাস্তা,নিচু স্টেশনবাড়ি
অপেক্ষায় বাঁধানো এক কৃষ্ণচূড়া
ঘুমের বার্থ থেকে একটু দূরেই
থেমে আছে শ‍্যাওলার ভাঙাঘাট
শুধু কপ্পুর জ্বালানো প্রদীপ ভেসে যাচ্ছে একলা
সরু তেলের বাতি হাতে এ গল্পও তবে রওনা হল
পাথুরে জলের চিরপথ...
পৌঁছবো বলে যেখানে শুরু করেছিলাম আমরা....






৩.
∆ মেরুন ডায়েরি ∆



বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে হবে আবার
ঘুমের বড়ি,শস্তা পার্লার আর লেবুজল
সন্ধেয়  হাঁটাও জরুরি নাকি
গতবারের চিঠিতে লেখা সমুদ্রঝড়
এবারেও আসবে না নিশ্চই
হালকা সুতির পোশাকে বেড়াতে যাবো আবার
সুস্বাদু ঘুমে শুয়ে পড়বে রাত
শুধু ফেরার সময় মনে করে
ডায়েরিটা নিয়ে যেও  তুমি
জাদু জানে মেরুন ডায়েরি,
নাম ধরে তিনবার ডাকে যেই
নিশি হয়ে ধারালো চুল খুলে দেয় অন্ধকার
শাদা বুকে মায়া এক আলো
উন্মাদ কথামালা খলবল জড়ায় এমন
মগজে ঝাঁক বেঁধে মৌমাছি ওড়ে
ধোঁয়া ওঠে তাবৎ মৌচাক ফুঁড়ে
মাথাভর্তি মধু আর মোম নিয়ে
লেখাদের ঘুম আসে বলো?
অক্ষর ঘুমোয় কখনো?





৪.
∆ চশমা ∆



দম আটকে আসতো বিকেলের
দূরত্ব বেড়ে গেলে খা খা করতো চশমা
শুরুতেই যার ঠিকানা হারানো এক চিঠি
বাতিল খামে লেখা ক’লাইন ছলছল করে
কেমন আছেন, দেখিনি কতদিন..
মামুলি কথার ফাঁকে মেঘ করে অমনি
আসলে জুলাইয়ের বুনো ঝড় সে বলতে চাইতো
ভুলে যাওয়ার আগেই সে বলতে চাইতো খুব
আর মনে পড়তো না
অথচ বিবাদ নাই কোনও
মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ উঠলেই স্বচ্ছ নেটের মতো চাকভর্তি আলো
নীচে তড়বড় করে চেনা মুহুর্ত...
উড়তে চায় বলে হুহু করে ওঠে
লিখতে গেলে যেমন হাত কাঁপে বড্ড
ত‍্যাড়াব‍্যাঁকা লেখা থেকে মৌমাছি উড়ে যায়
দ‍্যাখে চশমা নিজেই আলো কমিয়ে আনছে
মজাদার ভঙ্গি করছে ছায়া
টাটকা যুবকের হাসিতে দম আটকে আসে বিকেলের
শুধু চশমা থেকে রোজ জল পড়ে বলে
গোধূলির আবছা তাকে খুলে ফেলে অন্ধ হয়ে যায়…!





৫.
 ∆ পাথর জন্ম ∆




বালি খুঁড়তে খুঁড়তে আমরা তুলে আনলাম
অচেনা শহর.. তার রাস্তা
শিলাখন্ডে চাঁদ উঠল যেদিন
এদিক ওদিক ছড়ানো ভুল থেকে তুলে আনলাম
স্পর্শকাতর আয়না, মায়াবী আঙুলছাপ
নমুনা সংগ্রহের একেবারে নিচে
থমথমে প্রাচীন সুড়ঙ্গের অভিমান
নর্তকী ও দীপদান ঘিরে তখনও উড়ছিল
ভাঙাপ্রাচীর,জোছনার খিলান,নগরের প্রধান দরোজা..
এ শহর বৃষ্টিহীন !
কাত হয়ে পড়ে আছে কলস ও গনস্নানাগার
নাচের মুদ্রায় পাথরের নারী পেরিয়ে আসছিলো
তামাটে দিগন্ত ও ধুধু অবকাশ
ফাঁকা চোখে সে তুলে ধরছিলো জলপাত্র
টর্চের আলো পড়তেই খসে গেল চোখ
ধুলোর আস্তরে চাপা পড়ে আছি কত অশ্রুযুগ
মরা নদীখাতে এত রক্তমেঘ দেখে হতবাক তুই
সিঁড়ির পর সিঁড়িতে মৃত প্রজাপতির স্তুপ,
চুলে জড়ানো হাড়ের মালা  ডিঙোতে গিয়েও
মনে পড়ছে না, তোর মনে পড়ছে না
তোর জন্য সে জন্মেও অপলক পাথর ছিলাম?





শিল্পী- প্রতাপ হালদার


০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০