Saturday 20 March 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৩


শেখ ইমাম উদ্দিন এর কবিতা-




∆ নৌকা সিরিজ ∆

        
১.
সাদা পাতার শেষে রেল লাইন

বৃষ্টি হলে সবুজ মিথ্যাচার
রক্তমাংসে বন্ধ চোরাগলি
উত্তেজনার অকাল অভিসার...

বিষণ্নতা বিলাসী শীতকাল
অঙ্গের মাঝে নৌকা ডুবে যায়

কাঁদলে এখন সিলিং কেঁদে ওঠে
অন্ধ হলে আঙুলে জ্বর নেই...



২.
সহজ চিনিকলে সংযোগ নেবো
বদলে নেবো বেশিদূর...

ইশ্বরের মাঝে বেঁচে আছো শিমূল গাছ
অসমগ্রন্থনে তীব্র ভাঙা সুর...

গ্লানি এবং বাগান ছুঁড়ে দিয়ে
সবুজ গোলাপ নৌকা দাবানল...

সভাঘর শব্দের ভিতর ধোঁয়া
নকলনবিশ কপাল ঠান্ডা জল...



৩.
একদিন সমুদ্র থেকে উত্তরাধিকার চেয়ে
দেওয়াল তুলে দেবো
বেড়ালের মত চোখ করে রং খেলবো
পাতাবাহার ধ্বংস  করে নেবে বেঁচে থাকা... 

মিশে গেলে বন, শব্দের মেঘ
কবিতা, স্বপ্ন, অডিটোরিয়াম...



৪.
অন্তমিলের শেষে কৈফিয়ত
ভোররাতে নৌকা ফুলের মত
ভেসে ভেসে শেষ চাওয়াটুকু...

দখল করে তফাত যাও পাতা
শরীর নাও, ভাসিয়ে নিয়ে চলো
অতৃপ্তি, ধাপে ধাপে নিরুত্তাপ চোখ...



৫.
একদিন নলবনে রং দেবো
চার চারটে পাহাড়, রক্ত এবং নদী

সেমিকোলনে শরীর জেগে থাকে
শ্লেষ মাখলে এফোঁড় ওফোঁর জল

মৃত্যু অবৈধ শব্দের মত
পদ্মা নদী, অভিযোগ আর একাকিত্ব...




ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৩


প্রসাদ সিং এর কবিতা-





১.
∆ কথা ও দূরত্ব ∆


 
১.
কথা লুকিয়ে রাখলে 
বেড়ে যায় দূরত্ব 
২.
পরে সেই কথা বলতে গেলে 
মাঝ রাস্তাতেই মরে যায় শব্দগুলি 
৩.
পাশে দাঁড়িয়ে দেখে সৌজন্যবোধ 
    
   
    
২.              
∆ ফুলের বাগান ∆



১. 
একটাই ফুলের বাগান ছিল পৃথিবীতে 
আসলে পৃথিবীটা একটা ফুলের বাগান ছিল 
হতেও পারে পৃথিবীটা একটা ফুল 
২. 
ফুল গুলো ফল হয়ে গেলে ভোগ করত জীবেরা
৩. 
তারপর আমরা পাঁচিল দিতে শিখলাম 
এবার ফুলের বাগান আমাদের না 
 না জানি ফল ফলিয়েছে কোন প্রজাপতি 
৪. 
আসলে পাঁচিলগুলোই আমাদের 
                     


৩.
∆ উপসংহার ∆


১. 
ক্লান্ত মানুষের কোনো উপসংহার হয় না 
সে ইতিমধ্যেই হেঁটে এসেছে বহু লম্বা পথ 
৩. 
ঘাম ঝরে ঝরে বয়ে গেছে যে নদী 
তার ধারে বসো 
বসে দেখো কিভাবে পরিশ্রমের শব্দ শোনা যায় 
 


৪.                          
∆ ফটো ফ্রেমের ঈশ্বর ৩ ∆



১. 
ফটো ফ্রেমের ঈশ্বরের দিকে তাকাই 
ঈশ্বরের মধ্যে দেখি নিজেকে 
হতেও পারে তা বোধহয় কাঁচের কারসাজি 
২. 
স্বর্গীয় আলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা 
আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাই 
ঈশ্বর বোধহয় দেখছেন ভাবলে আলো নিভে যায়
                            



৫.
∆ সবং-ঘাটাল রোডের কোনো এক কালভার্ট ∆
 


১. 
ওপর দিয়ে রাষ্ট্র দৌড়ে যায় 
টলতে টলতে হেঁটে যায় শোকাতুর মাতাল 
বুকে ভর করে চলে যায় বিকলাঙ্গ কেউ 
২. 
কালভার্ট এর তলায় খাওয়া ঘুম বসবাস 
সেখানে কেউ পৌঁছায় না 
যদিও তাদের আছে আধার ভোটার রেশন কার্ড
৩.
কেউ কথা রাখেনি বিগত সাত বছর 
কেউ কথা রাখেনা
হয়তো কেউ কথা রাখবে না আগামী বছরেও





ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৩


দেবার্ঘ সেন এর কবিতা-




১.
∆ ভাস্বর ∆



বেছে নিচ্ছি নিজের মত কিছু শব্দ
ধ্রুবতারাকে সাক্ষী রেখে।
অথচ কি মেঘ করে আছে চারিপাশ।

গাছের নীল পাতারা আকাশের দিকে চেয়ে
স্মিত হাসি হাসছে।

বেছে নিচ্ছি কান্নার প্রতিশব্দ মানুষের স্রোতে।
যেখানে শুধু জল খেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায়, এই ভাস্বর জীবন।




২.
∆ তর্জমায় ফিরি একা ∆



যাওয়ার পথে পড়েছিল হরেকরকম মুগ্ধতা,
অনন্য সব স্বাদ। স্রোত কম্পনে দোল খেতে খেতে
আত্মরতির নার্গিসফুল।
তুমি এলে, ঝর এলো
উন্মদা হল পারিপার্শ্ব
গহীন মেঘে ছেয়ে গেল শতাব্দী প্রাচীন তুলট আকাশ
যেন কোনও রূপকথার, টুকরো ঝরা হৃদয়পুর।


আহত কোলে কুড়িয়ে নিলে আমাকে
পথশিশুর প্রতি তোমার মমতাময়ী স্পর্শ
জাগিয়ে তুলল নিশিদিন উচ্ছ্বাস
সে ভাবল স্বর্গ পেয়েছে, পথশিশু তো! 
স্বপ্নের কাছে হেরে গেল, ক'দিনের পুলকসঞ্চার
সর্বনাশটা লুকিয়ে রাখতে হবে
এইটুকু শর্তেই পথশিশু চিনে নিল তার স্থান
ভাগাড়ের পূর্বাবস্থায়..




৩.
∆ সোপর্দ ∆



দুটো মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে।
মন্থর বেগে মেঘেদের চলে যাওয়া..

পরিস্থিতির জলে অশূন্য অঙ্গীকারের
এক সাদাকালো প্রতিফলন।

বন্ধন, বন্ধনের কাঙ্ক্ষিত সম্পদ
অথবা অরণ্য

মানুষ দুটোর পুড়ে যাওয়া মুখ।
স্বতন্ত্রতা, যেন শুধুই নির্ঘুম এক প্রশ্নচিহ্ন..

তাঁদের আর দেখা যাবে না হয়ত কোনওদিন

ভেঙে যাওয়া ঘরের পাশে,
সোপর্দ প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষরিত কাগজ..

তাতে চাপা দেওয়া
দুটো মানসিক অসুস্থ ইট।




৪.
∆ পরিক্রমা ∆



পাপবোধের তৃপ্তি বিন্দু থেকে
ঊর্ধ্বগামী একটা পিঁপড়ে যে
মহাজাগতিক হয়ে গেছে সে খবরটা কেউ রাখেনি।

ন্যাকামির একটা পর্দা সরালে যারা
আরেকটা ন্যাকামির ওড়না টানে
তারা আসলে লিঙ্গ নির্বিশেষে ল্যাংটো।

ওই পিঁপড়েটার পরিক্রমা এই কথাগুলোই
লিখে দিয়ে গেছে..




৫.
∆ ঘাট ∆



দেওয়ালের মালিক জানিয়ে দিয়েছেন দেওয়ালে
" এখানে প্রস্রাব করিবেন না অথবা নো নুইসেন্স "
তলায় একটা নর্দমা দুপাড় বাঁধানো..

একটা মুখমণ্ডল, দেওয়ালেরই মত রঙ

সেই মুখমণ্ডলের মালিক জানায়নি কিছুই
পরিচিত লোকজন প্রস্রাব করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। 

তলায় একটা মুখ, দুপাড় বাঁধানো 
এক পাড় ওষ্ঠ আরেকটা পাড় অধর। 





ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০



কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৩


রুমি’র কবিতা-



১.
∆ স্বপ্ন ∆



একটা শতছিন্ন কাঁথায় পাঁচজন শু‌ই,

টানাটানি করে টুকরো টুকরো সুখ ভাগ করে নিই চোখের পাতায়;

মনে পড়ে সেদিন শাস্ত্রীয় গানের জলসায়-

হঠাৎ সুর ছেঁড়ে,ছেঁড়া তানপুরার তারের সাথে - 

দু'প্রান্ত জোড়া লাগেনি ,তবু তানপুরাটা ফেলে দেয়নি....

পূঁজিবাদীরা আমাদের ওখানে ঢুকতে দেয় না, তবু আমরা সব জানি!

তথ‍্যগুলো বাতিল টায়ারের খোলে

জমা তরলে গচ্ছিত রেখেছি,

সাম‍্যবাদের প্রতিষ্ঠা হবে কাল।

আজ আমি সাঁওতাল রমনীর স্বপ্ন দেখি

আঁটোসাঁটো চেহারার-

মুকুটের মত হেলানো খোঁপায় গোঁজা জলজ লিলি -

ওর নাম 'মধূপ'......

আমার 'টাড়বারো' হ‌ওয়ার‌ ইচ্ছা খুব।


  



২.
∆ সেভাবেই ∆



যেভাবে ক্ষয়ে যায় মুগ্ধ চাঁদ, ঝাঁঝি জ্যোৎস্না ও  রূপোলী রাতে-


যেভাবে রোজ মরে মাতাল নদী, উড়ে চলা বৃরের দমকা হাওয়ায়-


যেভাবে জোনাকীরা ওড়ার শেষে ভুলে যায় প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার-


সেভাবেই প্রকৃতি আধঘুমে কেঁপে ওঠে,

স্বপ্ন ধাঁধায় হাসে জীবনের সরল হাসি,

সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে নিভন্ত প্রদীপ হাতে!


যেভাবে রাত্রির অগভীর ঘুমে, অভিজ্ঞতায় শিখে নেয় স্বপ্নময় সংগীত-


যেভাবে ভোরের চৌকাঠ ভরে থাকে প্রগাঢ় অন্ধকার শেষের বার্তায়-


যেভাবে কবর ভেঙ্গে উঠে আসে আবছায়া ঘোমটার বয়সী ইঙ্গিত-


সেভাবেই এলোমেলো পথ চলি,

পিছনে পথের বাঁকে থেকে যায় একলা হৃদয় !

আমার তখন ভিক্ষু বেশ, হাতের মৃৎপাত্র অদৃশ্য।


যেভাবে লাবণ্যরাত বৃষ্টিতে ভিজে অবশেষে হয় নিখোঁজ অভিসারীকা-


যেভাবে নাকচাবি নক্ষত্রফুল ছিঁড়ে পড়ে পথে জীবনের যা কিছু ধ্রুব-


যেভাবে তারুণ্য দুমড়ে মুচড়ে সঘন মেঘ জমে আকাশের গায়-


সেভাবেই বহুদিন পর আজ বৃষ্টির দিন,

জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু,

রাতরঙা শাড়িতে বেশ লাগে আঁধার!


যেভাবে হেমন্তের পাতাঝরা সমারোহে মধু যন্ত্রণা বুকে বাসা বাঁধে-


যেভাবে অন্তরের দূর্বা তরুণ জলের উপর ভাসে শরতের চাঁদ-


যেভাবে বিবশা দৃষ্টি মাপে পাখির ডানার মত ওচোখের মুগ্ধতা-


সেভাবেই সদ‍্য ভূমিষ্ঠ মোহ; ছায়া হয়ে হাঁটে, 

মধ্যরাতের উঠোনে পড়ে থাকে ভালবাসার শিউলী,

তবু কেন আবরণ খসিয়ে আভরণে সেজে উঠি জান?


  


৩.
∆ সমান্তরাল-পথ ∆



আলতো ধোঁয়াময় সন্ধ্যার কাঁধে ভর করে সমান্তরাল হাঁটা সহজ নয় গো ভ্রমর!

শরতের গন্ধ লেগেছিল যে বাতাসে, 

আগমনী গাইছিল শিশির ভেজা দূর্বার 

গৈরিক বসন-

তুমি তো দেখেছিলে!


নিঃশ্বাসে আলসেমি আমার একলা বিকেল; একাকী রাতে, 

কল্পিত মেঘে- 

কাব‍্য লিখি গো ভ্রমর,

টুকরো হৃদয় পেতে শুনি তোমার দীর্ঘশ্বাস!

নদীর গল্পে মগ্ন পাঠক হয়ে-

জেগে থাকি উল্কাবৃষ্টির আশায়! 

উৎসবের আমেজ মাখা ঘুঙুর রাতে 

আমি তো শুধুই শ্রোতা গো! 


কর্ষিত জমি যে বিপথগামী- 

বন‍্যার মত অবুঝ স্বৈরাচারে আনন্দিত,

তাও তুমি জানতে ভ্রমর! 

অপরাজিত মেঘে তৃপ্তির নিঃশ্বাস-

দেহের অলিন্দে ঝোলানো ছিল দাম্ভিক তাবিজ,

দহনে যে ভস্ম হয় গো স্বপনের গ্রাস- 

সঙ্গিহীন হয় পাখির চোখ!

তুমি তা বোঝনি ভ্রমর...

তুমি অত বোঝনি....


    


৪.
∆ শুইনচ্যিস-বো ∆ 



গাঁইয়ের লুকে জাইনত সুবাই 

বৌ ন‍্যেওটা আমি,

তুর লাজ‍্যে রাঙা গাইল‌, জানান দিত‍্য-

মু বট‍্যি মুন‍্যের মতন সোয়ামি!

সানকাড়া মাতা, নামো পানে চোক

পা দিয়েঁ মাটি খুঁট‍্যে-

ধুকপুকাইনটো বাড়‍্যিয়েঁ দিতিস

অঁয় যৈবনে লাড্ডু ফুট‍্যে!

নিকষ কালো আন্দার রেইতে

তু হলি মুর চান্দ!

চট্টাই পেইতে বাকুল‍্যে শুইতোম

থুব‍্যি মাত‍্যা বাড়‍্যিয়েঁ দিত‍্যোম, ভাল‍্যোবাসার কাঁন্দ।


তুকে লিয়‍্যে সিনিমা যাব, গরম ভাজ্জা চপ খ‌ওবো-

খিটক‍্যেইলে বাপ উটল‍্যে তেইড়‍্যে,

"নামুনেট‍্যোর চামটো উটিন ল‍্যুব!

ঘর‍্যে উন‍্য বো ঝিয়েরা লাইচব‍্যে মাত্তায় চ‌ইড়‍্যে!

বুইজব‍্যে নিক‍্যি লেল‍্যা উট‍্যো জম্ম শোদের এঁইড়‍্যে!"

বাপ্পের সঙে, গাঁয়ের সঙে কাটান দিলোম সাত-

তুক‍্যে লিয়ে পলায় এলোম বাগাইন ধ‌ইর‍্যে হাত!


বদ্দমানের তেল‍্যের কলে আটঘন্টা কাজ

তুর গন্দে মাতোয়ারা, ঘর‍্যে ফিরত‍্যোম লাইগত‍্য য‍্যেকুন সাঁজ।

পেত্থম পেত্থম শ‌ওরে এইস‍্যে

ঘোমটার ফাঁকফুঁকুল গ‍ইল‍্যে আইনকানুন দেইখ‍্যে, পত‍্যেই প‌ড়ত‍্যিস ব‌ইস‍্যে!

দেক‍্য আদেখলাট‍্যোই বট‍্যে! দেইকবি যদ‍্যি ঘোমটা খানিক সর‍্যা!

একগল‍্যা শরম লিয়‍্যে শ‌ওরে কী চল‍্যে! এইবিটিনি কী ব‌ইলবেক 'শালো' তুর শ‌্বউর ঘাট‍্যের মর‍্যা!

ঘোমটাখান সর‍্যায়ে দিত‍্যিই; তুর চাঁন্দ পানা মুখ ভাইলচ‍্যে শ‌ওরবাসী-

আহা্ তু মোর রানী হ‌ইলেও লাইকো র‍্যে দাস দাসী!


ফটফটিতে চ‌ইড়‍্যে স‍্যিদিন বন্দু আম্মার, মাস‍্যুদ এইল‍্য ঘর‍্যে-

ড‍্যাবড‍্যাবাইন তাকায় ছিলিস ফটফটিট‍্যোর 'পর‍্যে!

পোড়‍্যা কপ্পাল ব‍ট‍্যে, তেল কলেতে প‌ইড়ল‍্য কুলুপ সমসারেতে টান-

সাঁজের বেলা এলোম ঘরে শরীলট‍্যো আনচান!

হাট ক‌ইর‍্যে দোর বেবাক খুল‍্যা, গেল‍্যি কোত্তাকে আঁটকুড়‍্যার বিট‍্যি!

"আবাং তুম‍্যি চিরকেইল‍্যে" থুয়‍্যে গেল‍্যি চিট‍্যি!



 

৫.
∆ রাগ শিবরঞ্জনী ∆



যদি বলি জলের রঙ বসন্তবৌরি ;

আর, শরীর জুড়ে ছিল খাজুরাহের আকুল সন্ধ‍্যা!

কানে তখনও পোড়া মাটির বাঁশিতে -

রাগ শিবরঞ্জনী বেজে চলেছিল নিভন্ত স্বরে,

খড়কুটো খুঁজছিল আকৃষি ডুবো হৃদয়!

তুমি বিশ্বাস করবে না কি!


ভাবো, এমন‌ও তো হতে পারত! 

বেখেয়ালি জলঝাঁঝরির পাটাতনে- 

মরু ঝড় মাথা কুটে মরছে শন্ শন্ শব্দে!

তবুও তুমি চলেছ টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে-

আমার আভূমিলুণ্ঠিত আঁচল নিয়ে বিজয় কেতন উড়িয়ে!

অমনি আকাশ জুড়ে মেঘের মাতনে- 

ভিজে গেলাম তুমি আমি!


মনে পড়ে সেদিনের কথা!

অলক দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে তুমিময় জলবিম্ব দেখে-

মদমত্ত ছোট ডিঙি ভরে তুলে এনেছিলাম লাল শালুক ;

আজ জন মজলিসে গাজন সভায় হরগৌরীর মিলন পালা গাওয়া হবে,

তুমি সমাপ্তিতে শালুক ডাঁটির মালা গলায় এসো-

কথা শেষে ব‍্যথা যাপন করব-

আসবে তো!




ছবি- অঞ্জন দাস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০



কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-৩


মৌমিতা মিত্র এর কবিতা-





১.
 ∆ পরাজয়ের গা থেকে শব্দ খুলে নিলে ∆


স্বপ্ন ভাঙলেই
একেকটা মুহূর্ত করাতের দাঁতের হিংস্রতায় ভাঙতে থাকে
ছেলেবেলায় শেখানো রূপকথার গল্প;
মাঝপথে দিশা হারিয়ে
আবার নিয়ন্ত্রণের সুতোগুলোকে টেনে আনার চেষ্টায়
পরাজয়ের গা থেকে শব্দ খুলে নিলেও
আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে
সপ্তাহের প্রতিটা দিন;
কোথাও গিয়ে পৌঁছানো হয় না।
স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়ার অনভ্যাসে
আঙুলের গায়ে জমতে থাকে
জলের সরের আস্তরণ 




২.
∆ সকালের সন্ধানে ∆



জলের তুলিতে আঁকা পৃথিবীতে
শেষ দিন অবধি দেখতে চেয়ে
যে নদী পথ হেঁটেছিল
তার পরিচয় আজ জানে
কেবল আকাশের নীল ছুঁয়ে থাকা
গাছেদের গোলাপি পাতা -
যারা আলো নয় - আকাশের নীল -
অন্ধকারের নীল ছুঁয়ে আকাশ হতে চেয়েছিল

আমি সেই মালী যে গাছের গোড়ার সঙ্গে
সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায়
ভুলে গেছে ডাল-পাতার বিস্তার;
প্রতিদিন জল দেবার অছিলায় —
ছুঁয়ে দেখার বাহানায় — মাথা তুলে দেখেনি যে
সবুজের অন্ধকার

ভরাডুবির মুহূর্তে নাবিকের শেষ ইচ্ছেয় থাকা
ঘাসজমির মতো
আমার পৃথিবীর সংসার সকালের সন্ধান করুক
যেখানে অন্ধকারের আলোয়
প্রাচীন সেই নদীর গন্ধ গায়ে অপেক্ষা করছে
বিষন্ন গোলাপি গাছেরা




৩.
∆ এভাবেই দুপুরের বুকে ∆



দুটো নিবিড় ছায়ার পাশাপাশি একটা ছায়া
ঘন হবার সংজ্ঞা খোঁজে

দুপুরের ধার ধরে জড়ো হয়ে বসে
দুই সন্তান হাতে দুই মধ্যবয়সী

ভিড় পাবার আশায় ব্যাগ হাতে ট্রেন থামার ঘোষণা শোনে জনৈক হকার

সময় অনেকটা গড়িয়েছে দেখে তাপ গোটাতে থাকে
দাড়িওলা সেই বৃদ্ধ যার গল্পে
নুন-ভাতের গন্ধ উঠে এসেছিল

কথা না শুনলেও
এভাবেই দুপুরের বুকে
কথা তৈরি হয়; ভালোবাসে
আবার মরে যায় বিকেল ঘনিয়ে এলে।



৪.
∆ আত্মঘাতী ∆



হঠাৎ করে থেমে যেতে চেয়ে
বিশ্বাস গুটিয়ে নিয়েছে যে ছেলেটি
তার কাছাকাছিই কোথাও আমি থেকেছি
একসঙ্গেই গাড়িতে উঠেছি
যাওয়ার একটা জায়গা হয়তো তার‌ও ছিল
দরজা খুলে আর‌ও কেউ কোথাও বসে ছিল

অথচ আজ‌ও আমি সোজা হয়ে বসে
চোখ আড়াল করার অনুভূতি চোখ হারিয়েছে
হাই তুলে ঘুমকে প্রশ্রয় দেওয়ায়
এখন‌ও তাই সংশয় হয় না
চাল ভাগ করে, খাবার গুছিয়ে নিয়ে
আমাদের সবার রাত পড়ে যায়

দুটো টলমলে পা-কে
রেললাইনের ধারে সরে আসতে দেখেও
আমাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসে
ভবিষ্যতের অস্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে




৫.
∆ সম্পর্ক ∆


প্রতি রাতে আমি জেগে যাই।

প্রতি রাতে
একে একে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো
সামনে দাঁড়ায়।
ভিড় করে।

পোড়া খাবারের গন্ধ
রান্নাঘর থেকে একে একে
সব ঘরে উঠে আসে।
প্রথম রাতেই সকলে ছেড়ে গিয়েছিল
আমাকে ভার দিয়ে।
প্রতি রাতে পোড়া গন্ধ তাই
আমাকেই খোঁজে; কথা বলে।

রাত শেষে আমার ছুটি হয়।
প্রতি ভোরে
আমাদের সম্পর্কে আরেকটু নিশ্চয়তা আসে।




অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


Thursday 11 March 2021

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-২

কবি ঋতুপর্ণা সরকার এর কবিতা-



১.


∆ সুনয়না  ১ ∆



সুনয়না, 
জীবন শুরু করি চলো আমরা শুরু থেকে।
 ভরসার পাহাড়ে ডিঙিয়ে এগোবো কি
 আমরা? 

সুনয়না?
 অনাদায়ী অন্ধকারের শ্লথগতিতে
ভাঙবে কি 
তুমি ওই পাহাড় বা ইমারত?

 বিকেলের রং মুছে সন্ধ্যা নেমেছে,
অথচ তুমি তা দেখনি কতকাল!
বন্ধ জানলার ওপারেি আজকাল মেঘ আসে। 
তুমি সে সব কিছুই না দেখে
শুধু  মৃত্যু ভয়ের গল্প শোনাও।
 
কতরাত আমরা আড়ম্বরহীন প্রেমে 
অন্বেষণ করেছি মুক্তির, 
অথচ আমাদের ব্যাক্তগত ভূখন্ডটুকু 
তুমি হারিয়ে ফেললে! 

বিপন্নতা যখন ধর্ম হয়ে যায়
আর ভীরুতা অভ্যাস, 
তখন প্রেমের সব ফুলগুলি ঝুড়িতেই শুকায়।

মাটি খুঁড়ে দেখ সুনয়না,
 সেখানে লুকিয়ে আছে ব্যথা, খিদে, কষ্ট 
আর প্রেম,

 খুদকুঁড়ো বাঁচিয়ে প্রেম টুকু রেখো।
জানলা খুলে আলো আসুক,
আসুক অক্ষর, দিকনির্দেশ। 
যদিও ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা,
তবুও সুনয়না,
ব্যূহের ভেতর দাঁড়িয়ে 
শুরু করি আবার শুরু থেকে।




২.

∆ সুনয়না ২ ∆



সুনয়না,
মহাভারত পড়ছো আবার!
তবে যুদ্ধ কি আসন্ন?
 এবার তবে তৃতীয় পক্ষ আছে।

অস্ত্রে শান দিও,
 তৈরি করো নিজের বর্ম।
ভরসা নেই মৃত্যুরও আজ।

তাকিয়ে দেখো,
মহাকালও আজ নামছে।
কৌরব পাণ্ডব কেউ যদি না বাঁচে,
তবে কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস
তুমি লিখে যাবে তো?
 
তুমি মহাভারতের নিয়ম মানবে সুনয়না?
 বীরের হাতে বীরের মৃত্যু সম্মুখসমরে!

ঋণশোধ হলে পেছনে তাকিয়ে দেখো,
আজকাল বেশি যুদ্ধ ওখানেই হয়।




৩.

∆ সুনয়না ৩ ∆



সুনয়না,
তাকিয়ে দেখো
আজানের আলো পড়েছে পবিত্র চোখে 
হিমালয় শৃঙ্গ , উজ্জ্বল বর্ণের , নির্জন পরিক্রমা।
অন্ধকার সরোবরের তীরে ব্রাহ্মণী হাঁস
খুঁজে পায় নক্ষত্রপথ আর গন্তব্য আলো।
সে আলো তুমি দেখেছো?
সেই নরম আলো দুচোখে মেখে ভোর আসে সুনয়না
মিশকালো জীবনে বদ্ধ হলেও
এখনো আকাশে অতর্কিত চাঁদ আসে ।
গোপন আশ্রয়ে ঢোকার আগে একবার ছুঁয়ে নিও তাকে

দেখবে এক অলৌকিক জগৎ কে বন্দী করার বৃথা চেষ্টা চলছে পৃথিবী জুড়ে !
তবু আমরা বাঁচবো সুনয়না ,
সেই গভীর রাতের কথা ভেবে 
যখন ধূসর অন্ধকারে পথভ্রষ্ট হয়ে হটাত তুমি দিয়েছিলে চাঁদের আশনাইয়ের আঁচড়,
আত্মমগ্ন আমি পথ খুঁজে পেয়ে
 হাত ধরে তোমাতে মিলিয়ে ছিলাম 
চাঁদ তখন ফিকে হয়ে এসেছে তোমার খোপায়!
একা হয়েও আমায় সাথে রেখো সুনয়না,
দিনভর রোদে পুড়ে 
আমি শেষ বিকেলে যখন ফিরবো
দরজাটা খুলে দিও 
দুজনে মিলে সূর্যাস্ত হব আজ।




৪.

∆ জেনেসিস এর আর্ক ∆



একা থাকতে দাও হে ঈশ্বর 
আকাশের নীল আজ গাঢ় ..
তবুও প্রান থেমে যাচ্ছে। 
অনন্তকাল দেখি দিগন্তের স্তম্ভ একই উচ্চতায় 
অথচ আমরা শুধু নিজের মাপ নিয়ে গেছি। 
স্পন্দন আজ ঘাস চাপা ফ্যাকাশে 
যদিও বৃক্ষ আজ সতেজ ..
তাও বুকে  আজ নিঃশাস নেই 
ঈশ্বর একটু ক্লোরোফিল দিও। 
উপাসনার মন্ত্রে শুনি মরণচিত্কার 
প্রতিবিম্ব খুঁজেছি চুপিচুপি 
জলে শুধু বিষনীল আর বধির ছিটেফোঁটা। 
একা ধ্যান দাও ঈশ্বর 
রঙচটা গন্ধে মনষ্কামনার হদিশ হোক 
স্থির হয়ে ভাবি শুধু সৃষ্টি 
অথচ প্রতিদিন ব্যাধি থেকে ব্যাধিতর যখন 
পরিযায়ীও পিছু হটে তিলতিল। 
জীবন দাও ঈশ্বর 
সীমাহীন অচেনা রোদে পুড়ে গেছি 
উদ্ধতরা শিকড়ের  খুঁজছে অবশেষ 
নোয়ার ভেলাতে তবুও প্রান রেখো না 
অক্ষয় করো দয়া,প্রেম,বিশ্বাস,বিনয়।



৫.
∆ ফ্রেম ∆



আমার মা বৃদ্ধ  হলে কেমন হতো আমি জানিনা ! 
সাতচল্লিশ বছরের মা এখনো ফ্রেমে হেসে যায় , 
আমি দিন গুনে যাই -কবে আমি সাতচল্লিশ হব...
বৃদ্ধ মা কে জড়িয়ে ধরে ঘ্রাণ নেবো , 
মা র সেই অপূর্ব লক্ষী হাতের পাতায় রেখা জমবে 
আমি রেখাগুলো গুনতে গুনতে নেবো শশুরবাড়ি যাবার আগের পাঠ মায়ের কাছে ...
আমার বৃদ্ধ মা আমার মেয়ের কাঁথা সেলাই করে দেবে ..
আমি ফোঁড় গুনে যাবো- আমার বয়েসও , 
কবে আসবে আমার সাতচল্লিশ ! 
আমি দেখবো আমার বৃদ্ধ মা কে 
কেও বলেনি মাতৃমুখী মেয়ে সুখী হয় !




অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-২

কবি পায়েল দেব এর কবিতা-





১.
∆ নিরাকার ∆



বহুদূর বিস্তৃত ঘর৷ মানুষ শোক ফেলে যেত। এখন ভালোবাসা ফুটেছে,আশাবরীর সুরের মতো বিভা।কিছু শিশিরপাত বিছিয়ে আমরা শুতে যাই। দেখি দুটো হরিণ জিভে চেটে নিচ্ছে অসুখ। আমাদের ভাঙা পা দিব্বি জুড়া লেগে গেছে। হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছি ঘরের বিস্তৃতি। পেছন পেছন ক্রমে লম্বা হচ্ছে হরিণের ছায়া।
হা করে দেখছি ঈশ্বরের অবতার-
কিছু গাছ নদী হয়ে যাচ্ছে
কিছু দুঃখ বেড়ালের মতো 
কিছু কাক বিধবা-সাদা

চারপাশে পাথর 
পাথর ঢুকছে আমাদের ভেতর
আমরা ঈশ্বরের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছি




২.
∆ মরা-উপন্যাস ∆



এখানে নিহতের কোনো নাম নেই
বাকিরা নষ্ট নাগরিক 
মুখে মুখে ঘুমের মাউথ অর্গান

এমনি এক দেশে
আমরা বাস করি, হিজিবিজি লিখি, 
যা কিছু বোঝা যায় না
যেমন শালপাতার রং বেগুনি
তার উপর ক্ষুধার বাদামি লাইন
বোঝার মতো কি এসব?   

তবু হঠাৎ কম্বলটম্বল সরিয়ে
মরা আলোর ভিতর লিখতে বসলে
ভুয়া শব্দ সংশ্লেষ শেষ হলে 
আলো আসে,
শিশিরে শিশিরে জাপটে ধরে ধানের ডগা।
আর কে কাকে প্রথম চুম্বন করেছিল,তার নাম?  
কেউ লিখে না।

মৃতের তালিকা থেকে বেরিয়ে এক লোহা-খোঁজা যুবতী
ত্রিরঙা কাপড়ে কাচের চুড়ি বেঁধে
রোজ গেটের সামনে কান পেতে দাঁড়ায়

দূর থেকে হাঁক আসে, "ভাতফুল চাই ভাতফুল, লাল নীল হলুদ?"  




৩.
∆ রিপোর্ট ∆



মা আমার ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে হাঁটেন
ওর দাপাদাপিগুলি নিজের মধ্যে ধারণ করা ছাড়া ওকে শান্ত করা যায় না
আমি পারি না এসব
আমার এখনও হাঁটু ব্যথা নেই, মায়ের আছে

ডাক্তার বলেছে ইদানিং মায়ের শরীরে বাসা বেঁধেছে এক নিঃস্ব বাত 




৪.
∆ আশ্রয় ∆


ঘুমোচ্ছিলাম
পাশেই বিশ্রামরত ছিল ৭ ফুটী শ্মশান 
একটি চিল উড়ে এল
এসেই শ্মশানটিকে তুলে নিয়ে গেল
পিছনে কুকুরের মতো ধাওয়া করতে করতে
বৃষ্টির জঙ্গলে ঢুকে দেখি
মাঝ বরাবর সরু রাস্তা
অনেকদূরের পর একটি শুকনো খাঁখাঁ মাঠ
চিলের হাট বসেছে
কত লোকের শ্মশান এনে জড়ো করেছে তারা
ক্রেতার মতো ঢুকে পড়েছি বাজারে
হাঁটছি... 
কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না
মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি, নেই  
আবার কোনও বৃষ্টির জঙ্গল শুরু হবে  
হয়ত চিলের ছানারা কোনও চিলেকোঠায় 
লুকিয়ে ফেলেছে আমার শেষ আশ্রয়টুকু




৫.
∆ আশ্রয় ∆



উল্কাহত গ্রাম
মাইল মাইল পরিত্যাক্ত শালবন
কাউকে কথা দেয়নি
তবু প্রত্যেক আগামী বসন্ত অব্দি অপেক্ষা করা তার স্বভাব

বনের ভেতর একটি কোকিল 
বসন্ত ছুঁয়ে আশাবরী গায়

উল্কাহত গ্রাম- ঘর নেই,
ছাদ ঝুলে আছে দোলকের মত

বুকের ভেতরে একটি বাবুই 
ঘর গড়ছে,আর তছনছ করে দিচ্ছে অহরহ।




ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০








কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-২

কবি সমিধ গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতা-





১.

∆ মৃত্যু উপত্যকা ১৭ ∆



ফসিলের ঐশ্বর্য পেয়ে তুমি খুশি হতে পারো

নীরক্ত রাখালের বাঁশী থেকে গোরু এবং খাদ্য
কেড়ে নাও

সমুদ্র যেটুকু যুদ্ধ জানে
তার চেয়েও কৌশলী মুদ্রা অহর্নিশ ঝালিয়ে নেয়
গার্হস্থ চৌকাঠগুলো

ফসিলের ঔদার্য পেলে তুমি বিদ্রোহ করো

রংচটা টেবিল-ন্যাপকিন

স্ক্রু-ড্রাইভার হীন জেনারেটর

দড়কচা কয়েকটা একে অন্যকে ঘিরে
বসে থাকা মাথা

ঠিক কবে আর কোথায়
গুমটি ছাড়িয়ে গিয়েছিলো

মনে করবার নুলো চেষ্টা চালিয়ে যায়

আর প্রতিবার

সময়ের বাইরে রাখা জানলাটা গুলিয়ে ফ্যালে...

সময়ের ভেতরে থাকা জানলাটা খুঁজে পায় না...





২.
∆ মৃত্যু উপত্যকা ২৫ ∆




 সম্পূর্ণ ছাই থেকে সিগারেটে
ফেরার চেষ্টায়

সম্পূর্ণ পতাকার ওপর চোরাই
ম্যাপ আঁকার চেষ্টায়

সমূহ ঝুলঝাড়ু থেকে দেওয়াল টাঙানোর চেষ্টায়

সটান পরিচয়ের মধ্যে বর্ণ ভাঙবার চেষ্টায়

কথা যেসব মৃত্যু দিয়েছিলো
মৃত্যু যেসব কথা দিয়েছিলো

তারা আজ ইন্দ্রিয়ের লৌকিকতা
গ্রাহ্য করে না...




৩.
∆ মৃত্যু উপত্যকা ৪৮ ∆



ধোঁয়া সরে গেলে

পরপর অর্ধগলিত দেহ, হা-খোলা ঝাপসা লিঙ্গের

আস্ত পৃথিবীর ছবি, মহাকাশ নয় পড়শি মহাকাব্যে
বসেও দেখা যায়--

শেষহীন বর্ষাকাল থেকে উপর্যুপরি শেষতম স্বাধীনতার মতো

তীক্ষ্ণ শিসের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে থকথকে গায়ে হলুদের ঢঙে বয়ঃসন্ধি না-পেরোনো ঘৃণা...
শান্ত,ঠান্ডা,শোকহীন...




৪.
∆  মৃত্যু উপত্যকা ৩০ ∆



মানুষের ডানা থেকে একে একে
পাখি ঝরে পড়ে

মাঝপথে যেসব বই নিজের বুকে
আগলে নিত তাদের

গ্রন্থের কারাগার ছাড়িয়ে তারাও কবে থেকে,
স্বপ্নের অকারণ বিভিন্নতায়

"আজ এই পর্যন্ত" ব'লে উঠে যাচ্ছে যারা--
"শুরুটা কোথায় হ'লো" মনে করিয়ে দেওয়ার মত
কেউ তাদের স্বভাবে বাঁচে না

দেরাজে যাদের যত শুন্যতা হাতের পাঁচ ছিলো
'ঝিল্লিমুখর' শব্দের কাছে এসে,
একঘেয়ে হোঁঁচট খেয়েছে

সমুদ্রের নীলে অথবা কালোয় অথবা
দমবন্ধ করা সফেদ ফেনায়
ঝেড়ে ফেলা আঙুল ভেসে থাকে

নৈঋতের নিশ্চিত মেঘে কোনো বর্ষার
প্রেমিকের খবর আসে না...




৫.
∆ মৃত্যু উপত্যকা ২২ ∆


লুকোচুরি একরকম সম্মোহন
আনে

কনুইয়ের ভাঁজে সবার গোপন
মুখ নিয়ে
তৃতীয়া না আসতেই গয়না খুলে ফ্যালে
শশীকলা

লুকোচুরি একরকম মৌতাত আনে

সবার ঠোঁট ছিঁড়ে নিয়ে
বেমক্কা আঠা আর চুমু বসিয়ে দেয়

জিজ্ঞাসা না আসতেই পৃথিবী
বেহুঁশ হয়ে যায়

অ্যাটমিক শীত আর নৌকোর
সঙ্গম ছাড়া
শালীন আর্তনাদ হজম করতে
আর একজনও এগিয়ে আসে না...






অলংকরণ- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০


কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-২

কবি রুমা পণ্ডিত এর কবিতা




১.
∆ কথা রাখেনি রোদ ∆
 

সকাল হলো
রোদের অভ্যাসে
জানলায় সজোরে ধাক্কা দিতেই
পর্দা কাঁপিয়ে
হুড়মুড় করে ঢুকে গেলো পুরনো বিষাদ
আরো পুরনো কুয়াশাকে সঙ্গে নিয়ে।
হেরে যাচ্ছে আমার সঞ্চিত উত্তাপ
হারিয়ে যাচ্ছে দৃশ্যমানতা।
ধোঁয়াশা জর্জরিত আমার রোদ অপেক্ষা
অস্পষ্ট হয়ে তলিয়ে গেলো
শীত পাতালে।

রোদ কথা রাখেনি
সে আজ উঁচু কোনো মিনারে
অন্য কারো স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে
তাকে উষ্ণতার মানে শেখাচ্ছে।      




২.
∆ অলৌকিক ইতিহাস ∆



সূর্যের ফেলে যাওয়া
কিছু অবাধ্য রঙ নিয়ম মেনেই
নেশা গুলছে নোনা জলে,
আর কিছুক্ষণ
তারপর ওরা অলীক হয়ে
তলিয়ে যাবে ঝিনুকের বুকে।
সাগর নীলে একাত্ম হবে মহাকাল,
ঢেইএ ঢেউএ নক্ষত্ররা এসে
ছুঁয়ে দেবে রাত বোঝাই নৌকার শরীর।
দিগন্তের আবছা সবুজের গা ঘেঁষে
দাঁড়াবে আগুনরঙা স্বপ্ন
ছড়িয়ে পড়বে তার সোনালী উত্তাপ।

সময়কে বুকে জড়িয়ে
ওখানেই ঘুমিয়ে রয়েছে
অলৌকিক ইতিহাস।



৩.
∆ খাদ ∆



অন্ধকার অন্তরঙ্গতায়
দ্বিধাহীন আমার পরিচয়।
দু হাত ছড়িয়ে অহঙ্কার মাপি।
মন খুলে উড়িয়ে দিই সারাদিনের গুঞ্জন,
গর্বিত চুড়ার দিকে তাকাই পরিপূর্ণ ভাবে।
আত্মবিশ্বাসী নিশ্বাসে ঝরে পড়ে পাইন ফুল।
গভীর  রাতে
উন্মুক্ত  কণ্ঠে  তারাদের শোনাই
আমার রূপ বৈচিত্র্য।

চাঁদের সাথে গোপন বিবাদ,
রোদও শরীরের এক প্রান্তে
ছায়া ফেলে ব্যঙ্গ করে।

আলোয় অন্ধ সেজে
কালকের রূপকথায় রদবদল করি।
প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প লিখি
নিজেকে নিয়ে,
তারপর
রাতের অপেক্ষা...



৪.
∆ সিঁড়ি ∆


এখনও উলঙ্গ শরীর। 
কংক্রিটের কর্কশতা 
এখনও  ঢাকা পড়েনি
শ্বেত পাথরের মসৃণ অহংকারে,
এখনও হরিণী চলন
 আনমনা হতে পারে  নির্ভয়ে
প্রয়োজন হয় না আলাদা সতর্কতার।
 ধুসর  সিঁড়ির ধাপ 
এখনও মুখস্থ করতে শেখেনি
উত্তরণের গল্প।

এই সুযোগে নেমে যাই গভীরে 
আরো আরো গভীরে,
অন্ধকারের অন্তরঙ্গতায়
পাতাল যেখানে ধ্যানমগ্ন।  




৫.
∆ জীবন উপলব্ধি ∆


 প্রতিটি কক্ষপথে চুম্বক
মাঝে উৎস, "জীবন"।
মায়া তরঙ্গের অবিরাম স্রোতে
ভেসে বেড়ায় অসংখ্য খুঁটিনাটি।
বাছাই পর্বে বাতিলরা থেমে যায় 
স্মৃতির ভীড়ে।
বাকিরা ছান্দিক পায়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ।

গীতবিতান থেকে ব্যাংকের পাশবই
অকেজো শৌখিন কলম থেকে
হারিয়ে যাওয়া চাবির বিষন্ন তালা,
জং ধরা সময়ের সাক্ষী হয়ে
থেমে থাকা ঘড়ি,
নতুন বাড়ির দলিল থেকে ঘুমন্ত ডায়েরি
মূল্যবান বৈদ্যুতিক থেকে
কোণা ভাঙা ফ্রেমবন্দী হলদেটে আপনজন
হাজারো ভীড়।

এরপরও আছে
জীবনের টানে পরাজিত
অসংখ্য লৌহধর্মী স্বপ্ন।  



    


ছবি - বিপ্লব ভূঞ্যা

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

কবিতা

রঙ নৌকার ঢেউ-২

কবি চিরঞ্জীব হালদার এর কবিতা-



১.


আগামী ত্রিশ বছর পর এই আখ্যান টি পড়বেন।
তখন আপনাদের মূল্যবান আঙিনা
খরচ হয়ে যাবে হাঙর বা ক্যঙারু চাষে।

সমস্ত ধুধুল গাছে টং ঘর বানিয়ে
মেয়ে পিঁপড়েরা ছিপ ফেলবে
প্রেমিকের জন্য।

বান আসার আগে ঘরে ঘরে বিলিয়ে দেওয়া হবে
চিতা কাঠ। 
অথবা বেছে নিতে পারেন
ফার্নেসের ওয়েটিং লিষ্ট।
তবে দেখে নেওয়া হবে কাজু নামক ফলটি
আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় কিনা।

আর চন্দ্র অভিযানের জন্য
প্রতিটি মগজ কাঠামো অবধারিত ব্যবহৃত হবে
নৌকা স্বরূপ।




২.


আমরা প্রায়শই ভুলভাল চাঁদ দেখি।
আমাদের স্যাডিষ্ট লজিক।
বিপরীত প্লেজার।

গুরুদেব তুমি।
আর তোমাদের বাংলা চোলাই।
হে প্রেসিডেন্সির সিঁড়ি তুমি বুঝি
এভাবেই নিষিদ্ধ নিদ্রা কাতর।

এই নাও এক পুরিয়া ভ্যান গগ।
স্বনাম ধর্মী আত্মকথন।
ট্রাফালবাগ স্কোয়ারে
শব বাহকের ধর্মে
আমাদের দেখা হবে।

আমরা জানতাম না নাভিতেই আমাদের চাঁদ আত্মগোপন করেছিল।




৩.


ঘাড়ের কাছে খাবার চিন্তাহীন 
ক্ষুধার আঁচে সময় দেখো লীন।

 
নাইতে নেমে মৎস্য কিরণ জাল
তুমি এখন কোন দিঘীতে যাবে।
চতুর্দিকে খাদ্য হরিন পাল
তবুও তুমি ঈশ্বরীয় ভাবে।

ঘাড়ের কাছে খাবার চিন্তাহীন 
ক্ষুধার আঁচে সময় দেখো লীন।
খাদ্য বলতে এখন মহাকাশ
ক্ষুধা তোমার চিরকালীন দাস।





৪.


সুপর্ণার ভেতরে আর এক সুপর্ণা। 
তিনি প্রোম্পটার।
তিনি নাকি কেওনঝড় এর কোন এক খনি গর্ভে  আটকে ছিলেন সংলাপ শিকারের জন্য।
তখনো বেহালাবাদক কোন এক শুঁড়িখানায়।

অন্তর্যামী কালো পর্দা।
তিনি সারাক্ষণ ধরে থাকবেন রক্তমাখা পারস্য খঞ্জর।
নাট্যকার শেষ মুহূর্তে খুঁজে চলেছে কোন এক নটীকে যে আকাশকে নুপুরের মত পায়ে বেঁধে প্রথম অংকে অবতীর্ণ হবেন।

শেষ বজ বজ লোকাল যে কামরায় উঠি না কেন সবখানে দেখি সুপর্ণা বসে আছে।





৫.



কপট পর্দার কাছে আয়না স্থির হয়ে আছে।
ঠিক যেন যুবতী প্রেমিকা ।

কোথাও কোন ভাঙনের ভ নেই।
 কোথাও রক্তক্ষরণ নেই ।
অথচ ক্ষরণ এর অন্য নাম আয়না ।
উভয়ে প্রথাগত পতনে ঢলে পড়ে।

সে জানে কিভাবে একজনের ভিতরে প্রবেশ করার পর শিকড় গাড়তে হয়।
 শিকড় থেকে রক্তের মহোৎসব ঝরাতে হয় ।
কপট পর্দাটা ও ঠিক যেন ভাবুক শৈলী নিয়ে  
স্থবির ও জ্ঞানী।
মহা ভাবুক চেতনার নৈঋতে বসে থাকা 
করাল ঈশ্বরীর মতো দেখে নিচ্ছে একটি ভেড়ার চলন।

ধারালো কাতান তুমি তার কাছে কালো পর্দা।
কে বলবে কারো কোনো প্রত্যাশা নেই ।
শুধু একে অন্যের রক্তক্ষরণ দেখে যাওয়া ছাড়া।




ছবি- মেহবুব গায়েন

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০