মহিউদ্দিন সাইফ এর কবিতা -
১.
যখন উদ্ভিদ ছিল, সে বলত, তাকে যোনি বদলাতেই হবে। কেউ ডালপালা ভাঙলেও তাই দুঃখ করত না অন্যদের মতো। বসন্ত বাতাস এলে সে ফিরিয়ে নিত মুখ। ফুলও ফোটাত না। যোনি বদলানোর নেশায় সমর্পিত ছিল অনিমিখ। এমনকি পরজন্মের কথা ভেবে গরু ছাগল শুয়োপোকাদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে করত সখ্যতা।
যখন সে পূর্ণ মহীরুহ। অভিমানী ডালপালারা সব মমতাহীনভাবে বেড়ে গেছে। সেই আসন্নসম্ভব দিনে সাঁওতালপাড়া থেকে টামাক বাজিয়ে এল শিশিরপরশস্নিগ্ধ মাটির সন্তান। সিঁদুর কাজল লেপে শুরু হল পুজো। গাছটা সেদিন দেবতা হওয়ার গর্বে সারারাত হাত-পা নাচিয়ে গেয়েছিল আবির্ভাব দিবসেরই গান। আর তার ভেতর থেকে উঠে আসছিল পাথুরে ধ্বনির তীব্র ইঙ্গিত। বাসন্তী বাতাস, সে-ও বয়ে যাচ্ছিল পাশ কাটিয়ে। সন্তর্পনে অন্য জগতে।
২.
অচেনা পাথরে বসে যেদিকে তাকাই, বিস্মিত হই। দেখি নতুন জাহান। তার বিকিরিত ইশারা, কম্পন। এই সহজ মাটির বুকে তা-উম্র যখনই দেখেছি অন্ধকার। উন্মোচন হয়েছে জাহান। মলে ও কমলে বসেও পেয়েছি সমন্বয়। স্পর্শ করে জেগেছে শিহর, লীলায়িত বঙ্কিম জীবন।
দেখেছি। কোনো সম্পন্ন দৃশ্য নেই লণ্ঠনের এপারে ওপারে। তবু কার জেবা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি নিরালাতে। বারবার কত যে বসন্তঋতু এসে মুকুল ফুটিয়ে, ঝরিয়ে গেছে চলে, উৎসবযামিনী শেষে অনিবার্য দেশান্তরপথে। রেখে গেছে ক্ষতগুলি। কতগুলি স্তব্ধ বকুল আর বেলি। তাই তুলে, গভীরতম জোছনায় আমি অদেখা বনের পানে হাঁটি। সরে সরে যায় ক্রমে দেউল, সরাইখানা, জাতকের দেহগুলি, সঞ্চিত ভালোবাসা, বেদনা, বিষাদ, রাত্রি-দিন।
৩.
তাকে আমার পাওয়া হবে না কোনোদিনই। আমাকেও পাবে না সে জানি। চাঁদের লতাটি দেখে এই বেদনার বোধ আরও তীব্র হল। আবছা জোড়ের ধারে বসে বসে তাই তার মুখ আমি অপ্রাপ্ত রেখা-রঙে আঁকি। ডেকে ডেকে বসাই চারিভিতে নিমগ্ন মনোময় রাত। বন্ধুলি ফুলের পানা ঠোঁট আঁকি, দুটি চোখ ভীত কৃষ্ণসারিণীর, ভুরু জুলফিকার। খসলা ফুলের পারা নাক। গ্রন্থলকারবৎ কানের পাশেই শিরীষবিস্ময়ে কাঁপা নিবিড় কুন্তল।
তাকে দেবনা বেদনা আমার, হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া পাতার বিকার। গাজার মৃত্যুলীলা, জন্মভূমির ক্ষয়কাল, কিছুই জানাব না তাকে। যে যন্ত্রণা আমাকে স্থবির, বিবর্ণ করেছে, গহন বারতা অন্ধকার। আমি তার কিছুই দেবনা তাকে।
এই স্বল্প জীবনে সে সবকিছু বুঝে যাবার আগেই বলে ফেলব, "রাত্রি হয়ে এল। এই নির্জন জোড়ের ধারে আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।"
৪.
আমি কি বুঝেছি বলো কী অর্থ তার সন্ধ্যেবেলা ভিজেচুলে আসার? সে-ও কি জানে সে কেন আসে এত মাড়িয়ে কাঁটাতার? যখনই সে আসে এই নিরক্ত পটাকাশ প্রতিবাদ করে। ভেঙে পড়ে ফুলাধার, নিদ্রাহীনতার স্রোত বহে। আমি যুক্তিহীন বচন ফুকারি আর বিচিত্র মালা পড়ে ছিঁড়ে।
তবুও চাই, তার মুখের ভাষাই হোক ভাষা কবিতার। তার প্রেম, নিগূঢ়তা আর আসা কাছে, যেন এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকে।
কেননা কী হবে এত ভেবে?
তারই করুণা তাই এত ভালোবাসি। করুণা সরিয়ে নেবে, মাটির পুতুল ফের হয়ে যাব মাটি।
সমস্ত অশোক রইবে পড়ে।
ছবি - মেহবুব গায়েন
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
No comments:
Post a Comment