শাপলা পর্ব -৪
কবি সুনীল মাজি এর কবিতা -
১।। মেঘের মতো গল্প
••••••••••••••••••
মনে হলো গাছের ভেতরে বাসা বেঁধেছে চাঁদ।
মাটি থেকে অনেক উপরে এই বাসা । জন্মাতে জন্মাতে ভাসবে নবজাত।
প্রতি জন্মের এক আশ্চর্য অবস্থান থাকে। সেই অবস্থান মহেশ্বরী হতে পারে
আবার মহাসরস্বতী হতে পারে। এই অবস্থান নির্দেশ করে এই ধরাধামে তুমি
কতটা মাটি-আকাশ পেলে।
ভীষণ এক নীল আকাশ পাওয়ার জন্য আমি বাসা খুঁজে বেড়াচ্ছি ।
ভালোবাসলে সব বাসাই মাতৃগর্ভ হয় ---ভালোবাসলে বৃক্ষের পুষ্পগন্ধ পাহারা দেবে তোমাকে।
কোনও ঝড়বৃষ্টি তোমার স্বর ভাঙতে পারবে না-- যে- সঙ্গীত শুনতে চাইবে সুদূর অতীতে থেকে
সে অতিথি হবে কণ্ঠে ।
আলোরঙগন্ধসুর ছাড়াও মানুষ কখনো শব্দ কখনো নৈশব্দ চায় ।
তুমি যাকে পরম সত্যময বলে জানো, কেউ তাকে কল্পনা বা স্বপ্ন বা মহাকালী বলে ডাকে।
আমি তাকে মহালক্ষ্মী ভেবে স্মরণ করি ---সে আসলে এক ঐশ্বর্য ।
যেখানে পাহাড় আছে নদী আছে সাগর আছে আর আশ্চর্য সবুজ প্রকৃতি আছে
সে তো বাংলা, মহালক্ষ্মীর দেশ।
যদি সেখানে অভাব অনটন আর দ্বেষ ঘৃণা থাকে তবে বুঝে নাও
গাছের পাতায় শুঁয়োপোকা হযেছে। পাতায় রোদ নামছে না ।
আর সাপেরা গাছের গলা জড়িয়ে আছে।
প্রেমের গুটি দরকার তবে সর্প নিধনযজ্ঞে অগ্নিত্রিশূলও খুব জরুরী । চাঁদও রাহুমুক্ত হবে।
২।। সর্পযুগ অথবা খোলসের গল্প
•••••••••••••••••••••••••••••••••
দুজন শত্রুদেশের রাষ্ট্রনেতা যখন সংহতি ও মৈত্রীর কথা বলে
পরস্পরকে কোলাকুলি করে, আমি ভয় পেয়ে যাই।
মনে হয়, একটা সাপের দুটো মাথা ---দুই রাষ্ট্রকে পরস্পর গ্রাস করতে চায়।
নীলোৎপলকে বলি, ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভারতে আসেন তখন শুনেছি একটাও
ডলফিন বঙ্গোপসাগর আর আরব সাগর থেকে ডুব দিয়ে জেগে ওঠেনি !
নীলোৎপল বলে , ট্রাম্পের সঙ্গে কিম জন উনের এর করমর্দন দেখে সাগরের সমস্ত তিমি
দু’হাজার ফুট নীচে চলে যায়, একথা নাকি সমুদ্র বিজ্ঞানীরা বলেছেন ।
ভবেশ বসু বলেন, শি জিনপিঙ যখন মোদীর সঙ্গে দুবারের বদলে তিনবার বুক মেলান
তখন নাকি এই উপমহাদেশে সমস্ত অহীরণি কঞ্চুক ত্যাগ করে।
অন্নপূর্ণা জিজ্ঞেস করে, সর্পকুল খোলস ত্যাগ করল কেন দাদা ? ভয়ে ?
ভবেশ বলেন: ছলনার আতংকে। আতংক সব কিছুকে হিমশীতল করে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো,
মিথ্যের আশ্চর্য দূষণে মেরু প্রদেশের বরফ গলছে আর মেরুভল্লুক নিজের সন্তানকে খাচ্ছে।
সকলের মোবাইল ফোন একসাথে বেজে উঠতেই আমরা চমকে উঠলাম :
শুনিয়ে, করোনা ভাইরাস নাকি রাষ্ট্রনেতাদের হাত এবং মুখ স্পর্শ করতে ভয় পেয়ে গেছে,
তাছাড়া অনেক রাষ্ট্রনেতার ফুসফুস নাকি নকল ও ধাতব।
বুদ্ধদেব বলে চলেছেন, ফোনে আপনাকে পাচ্ছি না কেন? শুনুন এরকম নাকি
গুজব শোনা যাচ্ছে,মানুষ চাঁদে বসত করলে পৃথিবীতে আর জোয়ার ভাটা হবে না।
বলি, তাতে চিন্তার কী আছে ডি আই জি সাহেব ?
বুদ্ধদেব বলেন, আগামী প্রজন্ম পরস্পর শঙ্খ লাগবে স্থলে জলে কিন্তু চুম্বন খাবে না
মুখ বাঁধা থাকবে বলে চুম্বনের স্বাদ জানবে না।
৩।। চোখ
•••••
চোখে চোখ লেগে গেলে ঘুম পায় আজও---তখনই স্বপ্নের ভেতর অনেক পথ
ভাবি পথ কখনও ক্লান্ত হয় না, পথ ভেঙে গেলেও তার শরীরের আতিথেয়তা
এতোই স্বর্ণপ্রভা ছড়িয়ে থাকে দিনান্তের শেষেও মনে হয় কারোরই রশ্মিতে আলো কম পড়েনি।
আমার ঘুমের ভেতর কোনও ক্লান্তি নেই,কেননা ক্লান্তির জন্য আমি ঘুমাই না ।
অজানা এক পাখি গান গাইতে গাইতে চলে যায় : বিশ্রাম করো।
মুখে সে বলে না কিছুই তবু অই সুরের ভেতর এক আশ্চর্য আলো থাকে,আলোর গন্ধও থাকে
জন্মেঞ্জয বলে কে যেন জন্মান্তর ডেকে যায় ---এই এক দীর্ঘ পথ দীর্ঘ শ্বাস কেবল ওঠানামা করে।
শ্বাস বাঁকে না, বিশ্বাস বাঁকে না ---দুপাশে ছড়িয়ে থাকে যতি ও বিরাম চিহ্ন, জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় ।
পথ অস্পষ্ট হতেই পারে, কুয়াশা ও মেঘে পরিভ্রমণ করে বুঝেছি নিবিড়
সম্পর্ক মধুর, সখি, বিষময শত্রু।
সম্পর্ক যখন মাথার উপর চেপে বসে গাণ্ডীবে ভরে নেয় অস্ত্রসমৃহ তখনই ক্লান্ত পথিক
লক্ষকোটি স্নাযুপথে বিষন্ন বিপন্ন হয়ে ক্রমশ ঘুমে অবশ হয়ে পড়ে।
কৃষ্ণপথে হেঁটে দেখে তিরবিদ্ধ পথ : অশথের বুকে যেন তমাল বৃক্ষ ।
মনে মনে বলি, যে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুক বৃষ্টি হোক, ভিজে যাক চোখ।
৪।। বন্ধ ঘড়িটা হঠাৎ যখন সচল হয়ে যায়
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
পঁচিশে বৈশাখ আমি একটি স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু চাইনি--- পয়লা আষাঢ় আমি একটা
প্রেমের কবিতা লিখে কালিদাসের অভিজ্ঞান সঞ্চয় করতে চেয়েছি।
মহালয়ার দিন মায়ের পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে মুণ্ডেশ্বরীর বুকে হঠাৎই আমি পড়ে যাই ।
এই পড়ে যাওয়ার কোনও ঠিকানা নেই আত্মীয় আছে, মাটিজলের দাগ নেই আকাশের মেঘ আছে।
জীবনে আমি প্রথম চমকে উঠি দাদামশাই যখন বলেন : শ্মশান হচ্ছে পবিত্র কুটুম ঘর ।
সেদিন বুঝতে পারি, , ঘরের দেয়াল নাও থাকতে পারে---দূর্বা আর মুথা ঘাসের ঘর হল
মাটি আর আকাশ ...
আকাশের কোন স্থানটি শ্মশান ঠাকুরবাবা ? যেখানে আলো নেই--- যেখানে বৃষ্টি নেই !
আসলে কোনটা জন্ম আর কোনটা মৃত্যু ---কোনটা শ্মশান কোনটা ঘর আমরা কি জানি ?
কান্নাও এক স্বর ---তবে কোনও কোনও স্বর বর্ণ পায় না ব্যঞ্জন পায় না ---কেবল এক হুহু হাওয়া
শ্বাসের জন্য ঘুরপাক খায় আমাদের চারপাশে ---কোনও কোনও জীবন কখনও নক্ষত্র কখনও গ্রহ হয়ে ওঠে।
কবিদের নামে শিল্পী বিজ্ঞানীদের নামে আকাশের নক্ষত্রগ্রহের বা নদীর নাম করলে বেশ হয় না !
আসলে যারা চিরকাল পিরামিড আর পাথরের মূর্তি গড়েছে --- এরা কি সত্যিই বোঝে সৃষ্টি কী ?
পঁচিশে বৈশাখ অথবা পয়লা আষাঢ় আমি নদী পারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে গিয়ে
এক মহাশোকের সঙ্গীত শুনে ফেলি।
মেঘ থেকে বৃষ্টিধ্বনি নেমে এলে মেঘের ওপারে সব প্রতিধ্বনি গ্রহনক্ষত্রপুঞ্জের কাছে যায় ।
অদৃশ্য আশ্চর্যের এই গভীর অগাধ জন্মমৃত্যুর বিস্ময় কে লিখবে কে ?
যে মানুষের স্বপ্ন নেই সে কিন্তু নাস্তিক--- স্বপ্নই ঈশ্বর---স্বপ্ন আমাদের যুদ্ধের সারথী হয়
গীতা বা গীতাঞ্জলি আমার কাছে স্বপ্নের ইস্তাহার ছাড়া আর কিছু নয়।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আসলে পৃথিবীর পরিযায়ী ছিন্নমূল মানুষের পায়ে চলার স্বপ্ন ।
পৃথিবীর সব শাসক অন্যের স্বপ্নকে শাসন করতে চায় ---তাই তারা আমার চোখে মৃত।
আকাশের যেখানে গভীর অন্ধকার সেখানেই তাদের বাস ---যার স্বপ্ন চলে যায়
সে ঘুমুতে যাওয়ার আগে অন্ধকারে শুয়ে পড়ে ।
৫।। রোদজ্যোৎস্না অথবা রামধনু কথা
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••
দরজা খুলতেই তুমি দেখলে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে এক আশ্চর্য
মেঘের ছায়া। বয়স বাড়তেই যখন শরীরে রোদ আর মনে জ্যোৎস্না পডতে শুরু করল
তখন বুঝতে পারলে নদীর মাঝ বরাবর যেখান দিযে কোকিল গান গায়,শঙ্খচিল উড়ে যায়
ওটাই গাঙ, ওটাই প্রথম আষাঢ়,ওটাই পয়লা ফাগুন
প্রতিটি নদীর এপারের ছায়া ওপারে মিলিত হতে চায়, তখন গাঙের একদিকে বাঁশি অপর পারে সানাই
যদি গাঙের উপর দিয়ে বিষুব রেখা ভেসে যায় তাহলে বুঝে নাও সূর্য ই উৎস
প্রেমে প্রতিটি মানুষ সূর্য বংশের সন্তান প্রতিটি মানুষী চন্দ্র বংশের সন্তান
যাকে তুমি কথা বলো আসলে সে তো মেঘ, যাকে তুমি বৃষ্টি বলো আসলে সে তো গান
বর্ষার সব প্রেমে পুরুষ অভিসারে যায়, বসন্তের সব প্রেমে নারী অভিসারে যায়
আলোছায়া মৃগয়ার পেছনে দৌড়তে দৌড়তে তুমি বিস্তৃত এক আকাশের সঙ্গে পরিচিত হলে
বৃক্ষ মাঠ জলাশয়রা তোমার বন্ধু হয়ে উঠল : এই বন্ধুত্ব অযুত হাজার বছরের ভারতবর্ষ
যমুনা নামের এক নদী হয়ে প্রতীক্ষা করছে রাধা, নক্ষত্র হয়ে প্রতীক্ষা করছে অরুন্ধতী,
কন্বমুনীর আশ্রমে শকুন্তলা, বর্ষার জন্য কদম্ব বসন্তের জন্য পলাশ
অভিসার আসলে এক সৌন্দর্যের অভিযান সুগন্ধের পরিক্রমা---বাঁশির সুর এখনও তো
চার হাজার বছর ধরে অভিসারে আছে
বিয়ের আগে প্রেম বা বিয়ের পরে প্রেম বড় কথা নয়, যদি ফুলের বাগানে গিয়ে
রামধনু দেখতে পাও , রামধনু কেবল আকাশে নয় মাটি ছুঁয়ে শ্বাসে বিশ্বাসে জড়িয়ে থাকে,
তখন এক পলকের জন্য তোমরা প্রথম প্রেমিক- প্রেমিকা, হরগৌরী।
অলংকরণ - পৌলমি দেবনাথ
→→→→→→→→→→→→→→→→→→→
No comments:
Post a Comment