কবি সোমনাথ প্রধান এর কবিতা -
১। এই রকেট জীবন
এই রকেট জীবন,
সিগারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
ক্রমশ এগিয়ে যাই
চিরায়ত অতীতের দিকে...
বায়োস্কোপে দেখতে পাই,
কাশের কেশর, সৌম ধুলো,
কাঁচা মাটির উপর তুলির প্রবাহ,
চণ্ডীতলা...
আর একটা স্পষ্ট মুখ,
বেঁটে মতো খেলার সঙ্গিনী,
কী যে নাম ভুলে গেছি,
বামুনের মেয়ে, যার জন্য
নিরামিষ খেলাঘরে
প্রথম দু'হাত পুড়েছিল,
শাক-পাতাদের জ্বরে...
২। প্রেম
মুহূর্ত থেকে মুহূর্ত পর্যন্ত সাঁকো বাঁধে তৃষ্ণা
জলের ধারণা জানতে গিয়ে আজ
চেনা হল
জোছনার আরেক প্রজাতি
ডুব দিয়ে তাই চলে যাচ্ছি
উদাস চাঁদের খোঁজে,
শুনছি, বুকের ভেতর প্রাচীন মাছেরা
বাজিয়ে চলেছে শিস
বন্ধুরা বলছে, প্রেমে পড়েছিস!
৩। ইসাবেলা নাসরিন
লাজুক প্ল্যাটফর্মে উড়ে এল দ্বিপ্রাহরিক পরিন্দা,
বেজে উঠল সিটি, দূরত্বকে গর্ভে ধরতে ব্যস্ত হ'ল ট্রেন,
বহুযুগ বয়সী এক স্মৃতি, সামনে দাঁড়াল হঠাৎ,
হেসে জিজ্ঞেস করল, 'ভাল আছেন !'
এভাবেই দেখা হয়ে যায় !
পরাঙ্মুখ সময়ও প্রাণের কাছে এসে
বাজিয়ে যায় বরণের রিং টোন...
কতদিন পর ! কতদিন পর ইসাবেলা নাসরিন !
শুভেচ্ছা, ভূমিকা আর ছাপোষা জিজ্ঞাসারা
একাকার হয়ে গেল, দুঠোঁটে নেমে এল অতীত আলোর জোয়ার,
টিকিট না কেটে ধরা পড়া সেই বাংলা এম.এ-এর ব্যাচে
রেল পুলিশের একমাত্র মেয়ে...
তখন পাকাপাকি স্কুলের দিদিমণি,
অথচ কী মিশে যেতেন সবার সাথে, ছায়া যেভাবে ছায়ায় মিশে যায় !
'একটা মিষ্টি ঘসঘষে গলা ছিল আপনার, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে
শুনতে শুনতে আমাদের জিভের উপর ঘুমিয়ে যেত চুইংগাম ।
একবার চানঘরে হল দুর্ঘটনা, বন্ধুরা ডাক্তার নিয়ে এলাম,
তারপর প্রেসক্রিপশন হাতে বেল্ট আনতে গিয়ে জেনেছিলাম
আপনার কোমরের মাপ !
তারপর ধুলোয় লেগেছে ফুলের গন্ধ, ঘুম হয়েছে টেরাকোটার রাজ্য...
কিন্তু পরনে এত অন্ধকার কেন ? বিবাহিত ?
সঙ্গে কি আছেন সেই অন্ধকারদাতা ?
তাঁকে বলেননি নিশ্চয়ই, রাতের পর রাত কীভাবে স্বর্গোদ্যান হ'ত
আদরের রাফ খাতা !
বলেননি নিশ্চয়ই, ঝোলা ব্যাগে কাব্যগ্রন্থের সাথে নদীর বাঁধ কিনে আনতাম আপনার জন্য, প্রত্যেক মাসে !
কতটা বন্ধু হলে নদীর বাঁধ কিনে আনা যায় নাসরিন ?
মনে আছে, আপনার জন্য এক মৌলবাদীকে চড় মেরেছিলাম ! হ্যাঁ, মহালয়ার নৃত্যে
দুর্গা সেজেছিলেন আপনিই, দর্শকাসনে এক ঘণ্টায় একশ সাতাশ বার বধ হয়েছিলাম ।
অথচ শুধু দ্বন্দ্ব আর বিতর্ককে ছুটি দিতে
একদিন, না ব'লে ফিরে গেলেন !
চিঠির পর চিঠি পিছু নিয়েও ফিরে এসেছে, ঠিকানা বদলে সেই যে হারালেন...'
এতক্ষণ চুপ ছিলেন নাসরিন । হঠাৎ অন্ধকার ফুটো ক'রে
কিছু জোনাকি যেন জ্বালিয়ে দিল বিপ্লবের মশাল ! কাঁপতে থাকা সেই
আলোর ভেতর থেকে জেগে উঠল
অবাক বাকপ্রতিমা...
বললেন, 'অন্ধকার প'রে আছি ব'লে
প্রত্নের সন্ধান নিতে কেউ আসে না, নিজের ইচ্ছে মতোই নিজেকে খুঁড়ি,
ইচ্ছে মতোই তুলে আনি, বৃদ্ধ রাতেও দুচোখে ছোঁয়াই
সে সব আলোর কণা,
আজও নদীর ঘুম ভাঙলে, আপনাকেই মনে পড়ে জনাব !'
৪। ব্ল্যাক হোলের দিনগুলি
একুশ রোল নম্বরের আলোর কাছে
এত অন্ধকার জানতাম না !
অঙ্কের ব্যাচে অনেকের স্বপ্ন হলেও
ভীন স্কুলের যমুনা জৈন
ধীরে ধীরে বুঝিয়েছিল,
সে শুধু এক রাসায়নিক প্রতিবেদন ছাড়া
আর কিছু নয় !
তড়িৎদার কাকুর মেয়েও একদিন
হৃদয় ভরাট করে মুখ ফেরাল
নতুন কোনও জৈবিক যাদুর অপেক্ষায়,
একটু শুধু আলাদা ছিল মুকুন্দপুরের মিতিন,
সাইকেল চালানো শিখে আমায় বলেছিল
রক্তিম আকাশের গল্প, অথচ তাকেই
তুলে নিল স্কলারশিপের ধেড়ে ঈগল,
সে তার ঠিকানা দিয়ে যায়নি...
তখন খুব কষ্ট হত, বাছা বাছা বিষাদ নিয়ে
বাড়ি ফিরতে খুব কষ্ট হত,
খালি মনে হত,
তুমি আরেকবার কুমারী হয়ে যাও মা,
আমি তোমার কোলে মাথা রেখে সব ভুলে যাই !
৫। ওগো বৈষ্ণবী
তোমার কপালে
চন্দন-পথের হেয়ার পিন বাঁকে
সে ছিল এক নিষিদ্ধ অবতরণ...
ধ্বংস ধ্বংস ভাবের মাঝেই যেদিন
ঘুরে দাঁড়িয়েছিল কীর্তনীয়া সময়,
ঝংকৃত প্রকৃতি যেদিন, সারা শরীর পেতে
ধারণ করেছিল বিগলিত উপাস্যকে !
আজও মনে আছে, মালার নীচে সেই রক্ত ফোটার শব্দ,
চন্দনের নীচে আশ্রয়প্রার্থী আগুন...
কম্পিত ত্যাগ-রঙের বেপথু হওয়ার মাধুর্যে
সে ছিল রামকিংকর বেজের সাতরঙা পাপের মতো
কোনও এক পার্বণ আমার...
ভেঙেছিল চন্দন পথ, মালা ছিঁড়েছিল, তবু
আজও সেই ছেঁড়া মালা
আমার চেতনার ছায়াপথ হয়ে আছে,
ভেসে আছে দুধ-সাদা স্মৃতিগুলো...
বসে আছি, শূন্যে নিয়ে সবই,
করতাল আর করতালির যুগলবন্দীর ভেতর
কষ্টের তেজে আজও
জন্মান্ধ তৃষ্ণাগুলো পোড়াচ্ছি
ওগো বৈষ্ণবী !
অলংকরণ - অতীশ কুন্ডু
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
No comments:
Post a Comment